
বিবি হাজেরা (রাঃ) এই জন-মানবহীন মরুভূমিতে শিশু ইসমাঈলকে নিয়ে থাকতে প্রথমে ভয় পাচ্ছিলেন কিন্তু যখন শুনলেন আল্লাহর ইচ্ছা, তাঁদেরকে এভাবে থাকতে হবে। তখন আল্লাহর ইচ্ছা ও আশ্রয়ে বিবি হাজেরা (রাঃ) সন্তুষ্ট হলেন। আল্লাহর আশ্রয়ের উপর কোন আশ্রয়ই হতে পারে না। অতএব, শুকর আলহামদুলিল্লাহ।
হযরত ইব্রাহীম (আঃ) আদরের স্ত্রী পুত্রকে রেখে সম্মুখে হাঁটতে লাগলেন। তারপর গিরি পথের বাঁকে পৌঁছে, এখন যেখানে কাবাগৃহ, সেখানে থামলেন। এবং কাবা গৃহের স্থানে মুখ করে দাঁড়িয়ে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে দোয়া করলেন, হে আল্লাহ! আমি জন শূন্য মরুর বুকে তোমার ঘরের কাছে আমার পরিজনদের বসতি স্থাপন করে যাচ্ছি। এই উদ্দেশ্যে যে তারা তোমার এবাদত বন্দেগী ও নামায ভালোভাবে আঁকড়ে থাকবে। হে আল্লাহ আরও লোকদের মন এই জনশূন্য স্থানের প্রতি আকৃষ্ট করে দাও। যেন এখানকার জনশূন্যতা দূর হয়ে যায়। আর ফলফলারি ও খাদ্যদ্রব্য আমদানী করে পানাহারের সুব্যবস্থা করে দাও। যাতে তোমার নেয়ামত উপভোগ করে মানুষ তোমার শোকর গুজারী করে।
ইব্রাহীম (আঃ) তাঁর গৃহে ফিলিস্তিনে ফিরে এলেন। মরুভূমির নির্জন প্রান্তরে বিবি হাজেরা (রাঃ) দু’একটি খুরমা খেজুর খেতেন ও পানি পান করতেন। আর শিশু পুত্র ইসমাঈল (আঃ) কে বুকের দুধ পান করাতেন। কিছু দিনের মধ্যেই পানি ফুরিয়ে গেল। তখন হাজেরা (রাঃ) নিজেও ভীষনভাবে তৃর্ষার্ত হলেন। এবং শিশু পুত্র আর বুকের দুধ পাচ্ছিল না। শিশু ইসমাঈল (আঃ) ক্ষুধা ও পিপাসায় ছটফট করে কাঁদতে লাগলেন। চোখের সামনে শিশুর ক্ষুধা ও পিপাসার যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে হাজেরা (রাঃ) পুত্রকে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝের নীচু স্থানে মাটিতে শুইয়ে রেখে, দৌড়ে সাফা পাহাড়ের ওপরে উঠলেন। এদিক ওদিক তাকাতে লাগলেন, কারো খোঁজ পাওয়া যায় কিনা। শিশুর চিৎকারে আবারও শিশু ইসমাঈল (আঃ) এর কাছে ছুটে এলেন।
না, কোথাও পানি পেলেন না। বাচ্চার কান্নাও থামছে না। আবার মারওয়া পাহাড়ের ওপরে উঠে দেখতে লাগলেন, কাউকে দেখা যায় কিনা। কিন্তু না কাউকেই দেখা গেল না। বাচ্চার চিৎকারে আবারও বিবি হাজেরা (রাঃ) শিশু পুত্র ইসমাঈল (আঃ) এর কাছে ছুটে এলেন। এভাবে, একবার সাফা পাহাড় ও একবার মারওয়া পাহাড়ে ছুটতে লাগলেন। আর বারবার নতুন আশাায় বুক বাঁধছিলেন, হয়তো কাউকে দেখা যাবে। হয়তো পানির কোন বন্দোবস্ত হবে। এভাবে সাফা ও মারওয়া পাহাড় সাত বার দৌড়ালেন। হঠাৎ একটি শব্দ শুনলেন। গভীর মনোযোগ সহকারে ঐ শব্দের প্রতি ধ্যান দিলেন এবং আবারও শব্দ শুনলেন।
বিবি হাজেরা (রাঃ) বললেন, কার শব্দ শোনা যাচ্ছে? কেউ কি সাহায্য করবেন? তবে অনুগ্রহ পূর্বক সামনে আসুন। এমন সময় শিশু ইসমাঈল (আঃ) এর সামনে একজন ফেরেস্তাকে দেখতে পেলেন। তিনি হযরত জিব্রাইল (আঃ)। শিশু ইসমাঈল (আঃ) শুয়ে কাঁদার সময় যেখানে পা দিয়ে আঘাত করছিলেন, জিব্রাইল (আঃ) পা দিয়ে সেখানটায় আঘাত করে গর্ত করলেন। তখন সেখান হতে পানি উথলে উঠতে লাগলো।
বিবি হাজেরা (রাঃ) বিস্মিত হলেন ও আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে শুকরিয়া আদায় করলেন। জিব্রাইল (আঃ) এর কথামতো হাজেরা (রাঃ) তাড়াতাড়ি পানির চর্তুদিকে মাটি দিয়ে হাউজের ন্যায় বাঁধ দিলেন। তারপর মোশকে পানি ভরে নিলেন। নিজে পানি খেলেন ও শিশুকে দুধ খাওয়ালেন।
ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্নিত, নবী করিম (সাঃ) বলেছেন, ”ইসমাঈলের মাতাকে আল্লাহ রহম করুন । তিনি পানির চর্তুদিকে বাঁধ না দিলে তা কূপ না হয়ে প্রবাহমান ঝরনা হয়ে যেত।”
এই কূপটিই এখনকার যমযম কূপ। আল্লাহর বিশেষ কুদরতে সৃষ্ট এই কূপের পানিতে অশেষ রহমত। তাই মক্কা নগরীতে শুধু এই কূপের পানি খেয়েই একজন মানুষ সুস্থ থাকতে পারে। যমযম কূপের পানি অত্যন্ত সুস্বাদু।
উৎপত্তির পর হতে এ পানি কখনই শেষ হয়নি এবং ভবিষ্যতেও শেষ হবে না। ইনশা-আল্লাহ। কূপের চারপাশে বিবি হাজেরা (রাঃ) খুরমা খেজুরের বিচি লাগালেন ও তাতে পানি দিলেন। ধীরে ধীরে অনেক খেজুরের গাছ হলো। তাইতো মক্কা নগরী আজ খুরমা খেজুরে এত প্রসিদ্ধ।
ফেরেস্তাকে জিব্রাইল (আঃ) যাবার সময় তাঁদেরকে এই শান্তনা বানী শোনালেন যে, যমযম
কূপের পাশেই পিতা হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও পুত্র ইসমাঈল (আঃ) আল্লাহর ঘর পূননির্মান করবেন। তাই তাদের ভয় পাবার কিছু নেই। আল্লাহর ঘর নির্মাতাদের আল্লাহ নিজেই হেফাজত করে রাখবেন। তখন সেখানে আল্লাহর ঘরের চিহৃ। স্বরূপ একটি উঁচু টিলার মত ছিল। তাও পাহাড়ী ঢলের স্রোতে ভেঙ্গে যাচ্ছিল প্রায়।
কিছুদিন পর জুরহুম গোত্রের একটি কাফেলা ঐ এলাকা দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ তারা দেখলেন কতগুলো পাখি কিছুকে কেন্দ্র করে উড়ছে। তারা জানতেন যে, পাখি পানির সন্ধান পেলেই এভাবে ওড়ে। তাদের অনুমান সত্য হলো। কাছে এসে দেখলেন, পাখিগুলো
যমযম কূপ কে কেন্দ্র করে উড়ছে। পানি পেয়ে কাফেলার লোকজন ভীষন খুশী হলেন।
তারপর বিবি হাজেরা (রাঃ) এর অনুমতিক্রমে তারা সেখানে বসবাস করতে লাগলেন। তাদের পরিচিত লোকদেরও খবর দিয়ে আনলেন। তারাও সেখানে বসতি স্থাপন করতে লাগলেন।এভাবেই যমযম কূপ, শিশু পুত্র ইসমাঈল (আঃ)ও বিবি হাজেরা (রাঃ) এর উছিলায় মক্কা নগরী আবাদ হয়ে গেলো। শিশু ইসমাঈল (আঃ) সকলের সাথে হেঁসে খেলে বেড়ে উঠতে লাগলেন। নবী হযরত ইব্রাহীম (আঃ)এর দোয়া পুর্ন হলো। আল্লাহর সকল ইচ্ছার পরিপূর্নতা পেলো।
------------------------------------------------------------------------------------
তথ্যসূত্র:
আলকোরআন: পারা; ১৩, রুকু-১৮, পারা; ১, রুকু-১৫। বুখারী শরীফ; হাদীস নং ১৬৩৫।
প্রকাশ ঃ দৈনিক ইনকিলাব; ১৯ জুলাই ২০০৯।
----------------------------------------------------------------------------------- By Khandaker Nazneen Sultana Journalist

No comments:
Post a Comment