Wednesday 7 May 2014

বাণিজ্যিক ও ইসলামী ব্যাংকিং-এর উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

আবদেলকাদের চাঁচি 

অনুবাদ: মাসুম বিল্লাহ
Journalist, 
The Financial Express
---------------------------
সারকথা
ব্যাংকিংকে বেশিরভাগ অর্থনীতিবিদ সাম্প্রতিককালের (খৃস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দি, ইতালি) একটি আধুনিক কর্মপদ্ধতি বলে মনে করেন। কিন্তু আর্থিক কার্যক্রমের উৎপত্তি ও বিকাশের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা বহুরকম ভাবনার উদ্ভব ও মিলিয়ে যাওয়া দেখতে পাব। এই নিবন্ধে তা তুলে ধরা হয়েছে। এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নিম্নরূপ :
    প্রথমত, খৃস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে ইতালিতে প্রচলনের অনেক আগেই প্রাচীনকালের জানা প্রায় সকল সভ্যতায় ব্যাংকিং কার্যক্রমের চর্চা হয়েছে, তা দেখানো;
    দ্বিতীয়ত প্রমাণ করা যে, ইসলাম এ ধরনের কার্যক্রমকে কেবল অনুমোদনই করেনি, একে এমনভাবে উৎসাহিত করেছে, যা আগের জানা সবকিছুকে ছাড়িয়ে যায়।
    তৃতীয়ত, দেখানো যে ইতালিয়ান ব্যাংকাররা ব্যাংকিং-এর কৌশল মুসলমান এবং মুসলিম বিশ্বের খৃস্টান ও ইহুদি বণিকদের কাছ থেকে শিখেছে। দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে এদের সঙ্গে ইতালিবাসীর ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল; এবং
    সর্বশেষে, বর্তমানে ‘ইসলামী ব্যাংকিং’ হিসেবে পরিচিত ধারার উৎপত্তি ও বিকাশের ধারাবাহিকতা অনুসন্ধান।

১. সূচনা
জ্যাক বারশার্ড (উদ্ধৃত লোপেজ, ১৯৭৯:১) বলেছেন: “ইতিহাস হলো অধ্যয়নের এমন একটি ক্ষেত্র যা শুরু থেকে শুরু হয় না।” আজকের রূপ নেয়া, বাণিজ্যের সবচেয়ে বিশেষায়িত ধরন ব্যাংকিং--প্রাচীন সভ্যতাগুলোর বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর আবির্ভাব ঘটে এবং বলতে গেলে প্রায় সকল সময় তা ছিল বিভিন্ন  জাতির সমৃদ্ধির ভিত্তি। তবে, অরসিঙ্গার (১৯৬৭:১) যেমনটা বলেছেন: “এ পর্যন্ত প্রাপ্ত দলিলের ভিত্তিতে, কখন প্রথম ব্যাংকিং কার্যক্রমের সূচনা হয়েছিল, তার প্রকৃতিই বা কেমন ছিল অথবা এর বিকাশের ব্যাপারে ধারাবাহিক নিরবিচ্ছিন্ন প্রমাণ দেয়া কঠিন”। তবে, বার্জিয়ারের (১৯৭৯:১০৫) দাবিকে সমর্থন জানিয়ে বেশিরভাগ অর্থনীতিবিদ মনে করেন: “ব্যাংকিংয়ের জন্ম ইতালিতে”। এর প্রথম কারণ, ‘ব্যাংক’ শব্দটি ইতালিয়ান ‘বাঙ্কো’ শব্দ থেকে এসেছে। যার মানে এমন কোন টেবিল বা বেঞ্চ যার ওপর ইতালিয়ান মুদ্রা-বিনিময়কারীরা তাদের মুদ্রা সাজিয়ে রাখতো এবং নথি বা লেনদেন লেখার কাজ করতো। 

দ্বিতীয়ত, তারা দেখান, খৃস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর দিকে ‘ব্যাংক’ নামের প্রথম স্থাপনাগুলো ইতালির ভেনিস, ফ্লোরেন্স, জেনোয়া ও লাক্কায় স্থাপিত হয়েছিল (দেখুন, উশের, ১৯৪৯ ও ডি রুভের, ১৯৫৪)। তাই ব্যাংকিংকে প্রায়ই সাম্প্রতিককালের একটি আধুনিক উদ্ভাবন বলে মনে করা হয়। কিন্তু, আর্থিক কার্যক্রমের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা অন্যরকম দেখতে পাব।

এই গবেষণার উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে এই নিবন্ধের পরবর্তী অংশটি নি¤œলিখিত অধ্যায়গুলোতে ভাগ করা হয়েছে :
    দ্বিতীয় অধ্যায়ে, প্রাচীন সভ্যতাগুলোতে ব্যাংকিং কার্যক্রমের উৎপত্তি অনুসন্ধান করা হয়েছে।
    তৃতীয় অধ্যায়ে দেখানো হয়েছে, কিভাবে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত মুসলিম সভ্যতায় ব্যাংকিং কার্যক্রমের বিকাশ ঘটে।
    রোমান সভ্যতার পতনের পর থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপে ব্যাংকিং কার্যক্রমের বিকাশ দেখানো হয়েছে চতুর্থ অধ্যায়ে। বিশেষ করে সে সময় ইটালিতে এর নাটকীয় বিকাশ ঘটার পেছনে কারণ ছিল দক্ষিণ-ইউরোপ ও মুসলিম সা¤্রাজ্যের সঙ্গে দেশটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
    পঞ্চম অধ্যায়ে, ইসলামী সা¤্রাজ্যের পতনের পর থেকে ১৯৫০ ও ১৯৬০ দশকে শুরু হওয়া ‘ইসলামী ব্যাংকিং’ পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বে ব্যাংকিং কার্যক্রমের ওপর দৃষ্টি দেয়া হয়েছে।
    ষষ্ঠ অধ্যায়ে রয়েছে উপসংহার।

২. প্রাচীন যুগে ব্যাংকিং

২.১. প্রাগৈতিহাসিক যুগে ব্যাংকিং

লোপেজ (১৯৭৯:১) বলছেন: “ব্যবসা ও বাণিজ্য সচল রাখার জন্য প্রথম কখন ঋণ ব্যবহার করা হয়েছিল, তা কেউ জানে না। সম্ভবত এটা হয়েছিল প্রাগৈতিহাসিক কোন সময়ে। কিন্তু, প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, গ্রিস ও রোমে এক ধরনের ব্যাংক চালু ছিল”। হোমার (১৯৬৩:১৭) লিখেন, “সম্ভবত শিল্প, ব্যাংকিং, মুদ্রার প্রচলন, এমন কি আদি রূপে অর্থের প্রচলন হওয়ার আগেও ঋণের প্রচলন ছিল।” তিনি উপসংহার টানেন এভাবে: “আমরা ঋণকে বৃহত্তর অর্থে বিবেচনা করলে এর প্রাচীন ধরন সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করতে পারি। প্রাচীনকালের ঋণকে আমরা দেখতে পারি পুত্র, ভাই বা কোন প্রতিবেশীকে বীজ ধার দেয়া হিসেবে, যা ফসল তোলার পর ফেরত দেয়া হতো। অথবা কোন পশু বা কোন সরঞ্জাম বা কোন খাবার ধার দেয়া হতো। ফেরত পাওয়ার আশা করা না হলে এ ধরনের স্থানান্তরকে বলা হতো উপহার। ফেরত পাওয়া আশা করলে তা হতো ধার এবং লাভসহ ধার হলো নির্দিষ্ট পরিমাণ ফেরত দেয়া, যা ধারের চেয়েও বেশি বলে আশা করা হতো।”

প্রথম লিখিত চুক্তি ও আর্থিক লেনদেন শুরু হওয়ার আগে মানুষ গবাদিপশু, খাদ্যশস্য, রৌপ্য বা মুদ্রা হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি এমন যে কোন কিছু ব্যবসা ও ঋণ হিসেবে ব্যবহার করতো (ডাভিস, ২০০২:১২)। দুঃখজনক হলো প্রাগৈতিহাসিক সময়ে এ রকম বা অন্যকোন ধরনের ব্যাংকিং কার্যক্রমের কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

২.২. মেসোপটেমিয়ায় ব্যাংকিং

যদিও কখন ও কোথায় প্রথম ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু হয়েছিল তা প্রমাণ করা অসম্ভব। তবে, হোমুদ (১৯৮৫:১৭) এর মতে এটা স্পষ্ট যে: “সংঘবদ্ধ কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের সূচনাপর্বে বিনিময়ের একটি মাধ্যম হিসেবে মুদ্রা ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে এর উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটে।” সভ্যতা হিসেবে সুমেরীয় ও ব্যাবিলনিয়ানরা প্রথম ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করেছিল বলে ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে খৃস্টপূর্ব ৩৪ শতকের দিকে এই সভ্যতার উন্মেষ ঘটে। অরসিঙ্ঘার (১৯৬৭:১) লিখেন: “পুরাতাত্ত্বিক খনন কজের মাধ্যমে ব্যাবিলনিয়ান সাম্রাজ্যের দুই পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন উরুক ও শালদিয়ে মন্দির আবিষ্কৃত হয়। সেগুলোই এ যাবতকালের জানা সবচেয়ে পুরনো ব্যাংকিং ভবন। আমাদের সময়ের ৩,৩০০ বছর আগে সেই ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালিত হতো।”

আবিষ্কৃত ঐতিহাসিক প্রমাণগুলো থেকে দেখা যায়, তখনকার ব্যাংকিংয়ের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সেগুলো ছিল মন্দিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। খাদ্যশস্য ও অন্যান্য পণ্য রাখার নিরাপদ স্থান ছিল সেগুলো। ডাভিয়েস (২০০২:৪৯) উল্লেখ করেছেন, “গচ্ছিত রাখা জিনিস কেবল আসল মালিককেই ফেরত দেয়া হতো না, তৃতীয় পক্ষকেও দেয়া হতো। মেসোপটেমিয়ার অনেক ব্যক্তি মালিকানাধীন আবাসও ব্যাংকিং কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিল।”
মেসোপটেমিয়ায় পাওয়া পান্ডুলিপিগুলোর একটিতে দেখা যায়, এক কৃষক তিল কেনার জন্য মন্দিরের যাজিকার কাছ থেকে কিছু পরিমাণ রৌপ্য ধার করেন। ফসল তোলার পর ঋণ নেয়ার প্রমাণপত্র বহনকারীকে রৌপ্যমূল্যের সমপরিমাণ তিল ফেরত দেয়ার অঙ্গীকার করেন তিনি (হোমুদ, ১৯৮৫:১৭-১৮)। এই দলিল থেকে অন্তত চারটি বিষয় অনুধাবন করা যায়:

    প্রথমত, এতে মন্দিরকে ব্যাংকের ভূমিকা পালন করতে দেখা যাচ্ছে। এর কারণ ব্যাখ্যা করা যেতে পারে এভাবে: ধর্মীয় উপাসানালয় ও যাজকদের প্রতি মানুষের আস্থা ছিল অন্য যে কোন কিছুর থেকে বেশি। এসব ধর্মীয় স্থাপনার সাধুতার সুনামের কারণে বিশ্বাস করা হতো যে, এখানে আমানতের সঠিক ও পরিপূর্ণ হিসাব থাকবে এবং এসব স্থান অন্যান্য জায়গার চেয়ে অনেক নিরাপদ। পবিত্র মন্দিরে চুরি করার সাহস কেউ করবে না।
    দ্বিতীয়ত, গ্রহীতা ছিলেন একজন উৎপাদক। অন্য কথায় ঋণ দেয়া হয়েছিল উৎপাদনের জন্য, ভোগের জন্য নয়।
    তৃতীয়ত, ঋণ দলিলটি ছিল একটি প্রতিশ্রুতিবহ
(promissory) নোট বা হুন্ডির মতো, যা ধার নেয়ার প্রমাণ হিসেবে গ্রহীতা দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, এটি ছিল বহনকারীর কাছে পরিশোধযোগ্য। অর্থাৎ হস্তান্তরযোগ্য।
    চতুর্থত, এই লেনদেনে মুনাফার কোন বিষয় ছিল না। ঋণ গ্রহীতা যে রৌপ্য নিয়েছেন, ফসল তোলার পর সেই পরিমাণ রৌপ্যমূল্যের সমপরিমাণ তিল ফেরত দেয়ার কথা আছে। এই পরিমাণ ধার করার সময়ের চেয়ে কম, সমান বা বেশি হতো পারে। এর পরিমাণ বেশি হলেও তা সুদ নয়। কারণ, সুদ হলো ধার করা পুঁজির ওপর বাড়তি যে অর্থ পরিশোধ করা হয় এবং তা হবে ঠিক একই ধরনের। যেমন রৌপ্যের জন্য রৌপ্য বা তিলের জন্য তিল। কিন্তু, রৌপ্যের জন্য তিল বা তিলের জন্য রৌপ্য হলে হবে না।
সে যুগে বড় পুঁজির ব্যাংকারদের মধ্যে ছিলেন রাজা এবং ধনাঢ্য ব্যক্তিরা। অর্থ বা বীজ বিনিয়োগ হিসেবে নেয়া হতো। অর্থের জন্য ২০% এবং বার্লির জন্য ৩৩% সুদ নেয়া হতো। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ বা কেউ ঋণ খেলাপী হলে ঋণ গ্রহণকারী, এমনকি তার পরিবার পর্যন্ত দাসত্ববরণের ঝুঁকিতে পড়ে যেতো। মুদারাবাহ’র প্রায় অনুরূপ সীমিত অংশীদারিত্ব ঈড়সসবহফধ ব্যাবিলনবাসীর আবিষ্কার। মন্দির ও বিশাল ভূ-সম্পত্তির মালিকদের ব্যাংকিং কার্যক্রম এতটাই বেড়ে গিয়েছিল এবং এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যে ব্যাবিলনের বিখ্যাত রাজা হাম্মুরাবি (১৭২৮-১৬৮৬ খৃস্টপূর্বাব্দ) এর জন্য একটি মানসম্মত বিধিমালা তৈরির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ভূমির মালিকানা, কৃষি শ্রমিক নিয়োগ, ফৌজদারি বাধ্যবাধকতা, ঋণ, সুদ, অঙ্গীকার, গ্যারান্টি, প্রমাণ থাকা বা না থাকা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ক্ষতি, চুরি ইত্যাদির ফলে সৃষ্ট প্রায় সব ধরনের বিরোধ নিষ্পত্তিতে এই বিধিমালা প্রয়োগ করা যেতো (হোমার, ১৯৬৩:২৬ এবং অরসিঙ্ঘার, ১৯৬৭:৮)। ৫৩৯ খৃস্টপূর্বাব্দে পারস্যের কাছে স্বাধীনতা হারায় মেসোপটেমিয়া। মহানগরী হিসেবেও জৌলুস হারায় ব্যাবিলন। সে সময় সুদের হার ৪০% পর্যন্ত পৌছে গিয়েছিল। এভাবেই একটি পুরনো সভ্যতা হারিয়ে গিয়ে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নেয় (হোমার, ১৯৬৩:৩১)।

২.৩. ভারতে ব্যাংকিং

ঐতিহাসিকদের বিশ্বাস প্রাচীন ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুগ হলো ‘সিন্ধু উপত্যকার সভ্যতা’, যা ‘হরপ্পা সভ্যতা নামেও পরিচিত। সিন্ধু সভ্যতার হরপ্প নগরীতে প্রথম খনন কাজ চালানো হয়েছিল বলে এই নামকরণ। খৃস্টপূর্ব ৩০০০ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যে এর বিকাশ ঘটে। বর্তমান পাকিস্তানের পুরো অংশ এবং বর্তমান ভারতের কিছু অংশ জুড়ে এই সভ্যতা বিস্তৃত ছিল। এটা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো সভ্যতাগুলোর একটি এবং মোসোপটেমিয়া ও মিসরীয় সভ্যতার সমসাময়িক। খৃস্টপূর্ব ২৬০০ সালের দিকে সমৃদ্ধির শিখতে পৌঁছে এই সভ্যতা। বাণিজ্য ভিত্তিক শহুরে সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে এখানে এবং এর অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি ছিল কৃষি। প্রতিবেশী সভ্যতা মেসোপটেমিয়ার মতো সম্ভবত এখানেও প্রচুর বাণিজ্যিক লেনদেন এবং ধার দেয়া-নেয়ার মতো ব্যাংকিং কার্যক্রম চলতো। তবে, এ বিষয়ে বিস্তারিত তেমন কিছু জানা যায়নি। তাছাড়া, হরপ্পা থেকে পাওয়া পান্ডুলিপিগুলোর পাঠোদ্ধারে ইতিহাসবিদদের সকল প্রচেষ্টা এ যাবত ব্যর্থ হয়েছে। সম্ভবত, আবহাওয়ার পরিবর্তন বা আর্যদের হামলার কারণে খৃস্টপূর্ব নবম থেকে সপ্তদশ শতকের মধ্যে এই সভ্যতার বিলুপ্তি ঘটে। সেই সময়ে ওই অঞ্চলে প্রাকৃতিক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল (দেখুন, উইকিপিডিয়া ওয়েবসাইট ও ন্যাশনমাসটার ওয়েবসাইট)। নিজাম (১৯৭৫:৩০৫-৩০৬) এর মতে, খৃস্টপূর্ব ২০০ থেকে খৃস্টীয় ২০০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে সুশৃঙ্খলভাবে বাণিজ্য, শহুরে বাজার, মেলা ও প্রদর্শনীর আয়োজন করা হতো। জোচ্চুরি, মজুতদারি, পাচার, ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণের জন্য রাষ্ট্র, গুদাম নির্মাণ ও বাজার নিয়ন্ত্রণের মতো কর্মকা- পরিচালনা করতো।

নিজাম (১৯৭৫:৩০৭-৩১১) উল্লেখ করেন যে, প্রাচীন ভারতে (খৃস্টপূর্ব ২০০ থেকে খৃস্টীয় ২০০ সাল) বিভিন্ন ধরনের, বিশেষ করে অংশীদারিত্বমূলক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান প্রচলিত ছিল। ঋণকে ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ধনাঢ্য ব্যক্তি এবং বিভিন্ন সঙ্ঘ-- ঋণ দেয়া ও ব্যাংকিং কার্যক্রম চালাতো বলে ধারণা করা হয়। 

সালেটোর (১৯৭৫:৩৫-১০১) প্রমাণের চেষ্টা করেন যে, খৃস্টীয় সপ্তম শতকের আগে সে সময়ের অন্যান্য সভ্য অঞ্চল ব্যাবিলন, রোম, গ্রিস, মিসর, পারস্য ও চীনের সঙ্গে ভারতের ব্যাপক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চলতো। তিনি জোর দিয়ে বলেন, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন এলাকার লোকজন আমানত, প্রতিশ্রুতি, বন্ধকী ও কোন দাতব্য প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী আয়ের উৎস হিসেবে সম্পদ দেয়াÑএসব কাজ করতো। এসব লেনদেনে, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না হলেও সুদের একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকতো। তিনি বক্তব্য শেষ করেন এভাবে: “একেবারে প্রাচীনকাল থেকেই ভারতে শুল্ক আরোপ এবং সুদ আদায় ছিল ব্যাংকিং কার্যক্রমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি কাজ” (পূর্বোক্ত:৬৬৮) 

২.৪. গ্রিস-এ ব্যাংকিং

অরসিঙ্ঘার (১৯৬৭:৩) এর মতে, স্থানীয় অর্থনৈতিক কর্মকা-ের অবস্থা, স্থানীয় আইনের কঠোরতা এবং বাণিজ্য ও লেনদেনের করুণ হালের কারণে আর্থিক মুদ্রা আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত প্রাচীন গ্রিসে ব্যাংকিং এর বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। এখানে যে প্রশ্নটি আসে তা হল এই মুদ্রার আবিষ্কারক কে এবং কখন? অরসিঙ্ঘার (১৯৬৭:৮) এর উত্তর দিয়েছেন: “সম্ভবত চীনারা, তবে এরও কোন নিশ্চয়তা নেই”। প্রথম খাঁটি সোনার পি-ের প্রচলন ঘটানোর কৃতিত্ব লিডিয়ার রাজা ক্রোয়েসাস-এর (৫৬০-৫৪৬ খৃস্টপূর্বাব্দ)। সে সময় শীর্ষস্থানীয় স্বর্ণ উৎপাদনকারী দেশ ছিল লিডিয়া। সপ্তম খৃস্টপূর্বাব্দে লিডিয়ায় সরকারিভাবে মুদ্রার প্রচলন ঘটেছিল বলে উল্লেখ করেছেন এনজিগ (১৯৪৯:২২৫), হোমার (১৯৬৩:৩৩), অরসিঙ্ঘার (১৯৬৭: ৮-৯) এবং ডাভিয়েস (২০০২:৬১-৬৩)। প্রথম মুদ্রার প্রচলন ঘটান লিডিয়ার রাজা সিগেস (৬৮৭ খৃস্টপূর্বাব্দে)। এগুলো ছিল ইলেক্ট্রাম (সোনা ও রূপার মিশ্রণ)। এটা গ্রিসে ব্যাংকিং কার্যক্রমের প্রচলন ও চর্চাকে উৎসাহিত করে থাকবে। কারণ, শিগগিরই কিছু বিক্রেতা মূল্যবান ধাতু দিয়ে তৈরি বিভিন্ন আকার ও ওজনের মুদ্রা মূল্যায়ণ ও বিনিময়ের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন (অরসিঙ্ঘার ১৯৬৭:৩)।

গ্রিক ব্যাংকারদের ট্রাপিজিটেজও বলা হতো। গ্রিক শব্দ ট্রাপেজা থেকে এই নামকরণ। যার অর্থ টেবিল বা বেঞ্চ। এর ওপর রেখে তারা মুদ্রা প্রদর্শন বা লেনদেন যেমন, মুদ্রা বিনিময়, আমানত সংগ্রহ, বিভিন্ন ব্যক্তি ও রাষ্ট্রকে ঋণ দেয়া, ঋণের স্বীকৃতিপত্র ইস্যু, প্রমিসারি নোট বা চেক এর দাবি পূরণ এবং এসবের পূর্ণ বিবরণ লিখে রাখাসহ অন্যান্য কাজ করতেন। হোমার (১৯৬৩:৬৯) মনে করেন: “গ্রিকদের বাণিজ্যিক মেধা এর পর আর কখনোই এতটা উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি।”
সম্ভবত পূর্ববর্তী সভ্যতাগুলো থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে গ্রিসেও মন্দিরগুলো আমানত সংগ্রহ ও ধার দেয়ার কাজে ব্যবহৃত হতো। দেলফি মন্দিরকে একসময় গ্রিক বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্যাংক হিসেবে আখ্যায়িত করা হতো (হোমার, ১৯৬৩:৩৮), কিন্তু আলেকজান্দ্রিয়া বিজয়ের পর ভূ-মধ্যসাগরীয় অঞ্চলের বাণিজ্যে নেতৃত্ব দেয়ার মতো অবস্থানে এথেন্স ছিল না। হোমার (১৯৬৩:৩৯) লিখেন, “আসন্ন শতাব্দীগুলোতে গ্রিস নয়, ভূমধ্যসাগরীয়  অঞ্চলের ইতিহাসকে প্রভাবিত করে রোম। সাম্রাজ্য হারানোর পর গ্রিস আর কখনোই ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে তার অবস্থান ফিরে পায়নি। রোমান নীতির কারণে বাণিজ্য রোডস, আনতিওক, সেলেনসিয়া এবং বিশেষভাবে আলেকজান্দ্রিয়া অঞ্চলে চলে যায় ।”

২.৫. রোম-এ ব্যাংকিং

হোমারের (১৯৬৩:৪৪) বর্ণনা মতে, রোমানরা ছিল কৃষক ও সৈনিকের জাতি। নির্মাণ, বাণিজ্য ও ব্যাংকিং-এর মতো কাজগুলো তারা মূলত বিদেশীদের কাছে ছেড়ে দিয়েছিল। প্রাচীন রোমান ব্যাংকারদের বেশিরভাগ নাম গ্রিক এবং তাদেরকেও ট্রাপিজিটেজ বলা হতো। অরসিঙ্ঘার (১৯৬৭:৫-৬) লিখেন, “রোমান যুগে কোন একচেটিয়া ব্যাংকিং ছিল না। তাই ব্যাংকিং কার্যক্রম স্বাধীনভাবে বিকাশ ও বিস্তৃতি লাভ করতে সক্ষম হয়”। প্রথম শতাব্দীর মধ্যে রিপাবলিক ও সাম্রাজ্য এবং সম্ভবত সে সময়ের জানা বিশ্বের মধ্যেও ব্যাংকিং কেন্দ্র হয়ে দাড়ায় রোম। তখন ব্যাংকারদের সংখ্যা এতই বেড়ে গিয়েছিল যে, ট্রাপিজিটেজ ছাড়াও তাদেরকে মেনসুলারি, আরজেনতারি, মাম্মালারি, ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হতো (হোমার, ১৯৬৩:৪৭)।

খৃস্টপূর্ব ৯০ সালের পর থেকে রিপাবলিকের রাজনৈতিক ও সামরিক পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকিং কার্যক্রমেও অস্থিরতা সৃষ্টি হতে থাকে এবং স্থবিরতা নেমে আসে। যুদ্ধ ও বিশৃঙ্খলার সময় মুদ্রাস্ফীতি, আর্থিক স্থবিরতা ও দেউলিয়াত্ব দেখা দেয়। আবার, শান্তি ও অগ্রগতির সময় আর্থিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসে এবং ব্যাংকিং কার্যক্রম ও ব্যাবসা-বণিজ্যের উন্নতি ঘটে। তৃতীয় শতাব্দীতে বিপ্লব ও গৃহযুদ্ধের সময় চরম মুদ্রাস্ফীতি দেখা এবং দিওক্লিতিয়ান (২৮৪-৩০২ খৃস্টাব্দ) ক্ষমতা গ্রহণের আগ পর্যন্ত দীর্ঘ পঞ্চশ বছর এই গোলযোগপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করে। ফ্রাঙ্ক এর মতে (১৯৩৩:৩০০) “তখন পতনের পথে রোম। চারদিকে নৈরাজ্য ও লুটপাট চলছিল। সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশ রোমের ওপর আস্থা হরিয়ে ফেলে। শিল্প ও বাণিজ্য ভেঙ্গে যায়। এমনকি ল্যাতিন ভাষাও ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ে”।

২.৬. মিসরে ব্যাংকিং

অরসিঙ্ঘার (১৯৬৭:৪) এর মতে: আলেকজান্দ্রিয়া বিজয়ের আগে মিসরে আদিম ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। মিসরে মুদ্রা ব্যবস্থার প্রচলন ঘটান টলেমি এবং গ্রিসের মতো এখানেও ঠিক একইভাবে এর বিকাশ ঘটতে দেখা যায়। গ্রিসের মতো এখানেও ট্রাপিজিটেজদের দেখা মেলে। তবে, এরা ছিল এক ধরনের সরকারি প্রতিনিধি; এদের অনেকের নাম ছিল গ্রিক এবং প্রথম দিকের ট্রাপিজিটেজরা গ্রিস থেকে আসে।” মিসরে মুদ্রা ব্যবস্থা চালু হওয়ার আগেই ব্যাংকিং ব্যবস্থা শুরু হয় সরকারি গুদামে ফসল জমা রাখার মাধ্যমে  (Netfundu, website (a))। ডাভিয়েস (২০০২:৫১-৫৪) লিখেন, রাষ্ট্রীয় গুদামে ফসল জমা রাখার মধ্য দিয়ে একটি ব্যাংকিং পদ্ধতি গড়ে উঠে। নিরাপত্তা ও সুবিধার জন্য যাদের শস্য সেখানে রাখা হতো, সেগুলো ফেরত নেয়ার সময় তারা লিখিত নির্দেশ দিতো। এছাড়া রাজাকে ঋণ হিসেবে বাধ্যতামূলকভাবে দেয়া শস্যও সেখানে রাখা হতো। এই প্রক্রিয়া শিগগিরই কর সংগ্রহকারী, পুরোহিত ও ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন জনের ঋণ পরিশোধের সাধারণ পদ্ধতি হয়ে দাড়ায়। বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য সরকারি শস্যাধার মিলে একসময় শস্য ব্যাংকের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করে, যা শেষ পর্যন্ত আলেকজান্দ্রিয়ায় একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্ম দেয়। সেখানে বিভিন্ন রাজ্যের শস্যব্যাংকগুলোর রেকর্ড জমা রাখা হতো। এই ব্যাংকিং নেটওয়ার্ক কাজ করতো ‘ঋণ হস্তান্তর’ পদ্ধতিতে
(giro system)। এক হাত থেকে অন্য হাতে টাকা স্থানান্তর ছাড়াই এক হিসাব থেকে অন্য হিসাবে ‘পরিশোধ’ করা যেতো।
খৃস্টীয় প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দিতে ধনসম্পদ ও সমৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যাংকিং শিল্পকলায় উন্নতির শিখরে পৌছে মিসর (হোমুদ, ১৯৮৫:১৮)। কিন্তু, খৃস্টীয় তৃতীয় শতকের দিকে রোমান সাম্রাজ্যের বিশৃঙ্খলা মিসরের অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতার বাধা ভেঙ্গে দেয়। আর তা হয় কেবল মিসরে প্রচলিত ছিল এমন সরকারি মুদ্রা
(fiat currency) ইচ্ছাকৃতভাবে বাইরে ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে (হোমার, ১৯৬৩:৫১)।

২. ৭. পারস্যে ব্যাংকিং

পারস্য প্রাচীন সভ্যতার অন্যতম সুতিকাগারই ছিল না। মধ্য এশিয়ার উর্বর ইরানিয়ান উপত্যকার পূর্বদিকে সভ্যতার বিকাশ ঘটে খৃস্টপূর্ব ১৫০০ সালের দিকে এসে। আর্ম জাতিগোষ্ঠী বিশেষভাবে মেদেসদের হাতে এই সভ্যতা স্থিতিশীল হয়। পারস্য সভ্যতার প্রথম মহানায়ক ছিলেন আখেমেনেস। খৃস্টপূর্ব ৭০০ সালের দিকে আখেমেনীয় রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। আখেমেনীয়রা পারসেপোলিসে বিশাল এক রাজধানী শহর গড়ে তোলে। সে সময় বাণিজ্য বৃদ্ধি পায় এবং বিশেষ করে ৫৩৯ খৃস্টপূর্বাব্দে ব্যাবিলন বিজয়ের পর ব্যাংকিং কার্যক্রমের ব্যাপক প্রসার ঘটে। পারস্যের ব্যবসায়ীরা ব্যাবিলনীয়দের ব্যাংকিং পদ্ধতি শিখে নেয়। বণিকরা উটের কাফেলা ও সাগর পথে জাহাজে দু’ভাবেই ইরান ও ভারতের মধ্যে পণ্য আনা-নেয়া করতো। পার্থিয়ান ও সাসানিয়ান যুগে বাণিজ্যের প্রসার এবং ব্যবসায় ব্যাংক নোট ও মুদ্রার ব্যবহারের ফলে দেশটিতে মুদ্রা ও নগদ অর্থের বিনিময় শুরু হয়। মুদ্রা খাঁটি কিনা তা চেনায় বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠে কিছু লোক। ৫১৬ খৃস্টপূর্বাব্দের দিকে আখেমেনীয় রাজা দারিউস দ্যা গ্রেট, লিদি বিজয়ের পর দেশটিতে ব্যাংক নোট ও স্বর্ণমুদ্রার ব্যবহার শুরু হয় (তেজারাত, ১৯৯৮, স্কট, ২০০৩, হেরার্ত, ১৯৭২)।
গ্রিসম্যান- এর (১৯৭১:৫৮-৬০) মতে, সাম্রাজ্যজুড়ে ওজন ও পরিমাপ এবং বিশেষ করে মুদ্রা ব্যবহারের প্রচলন ঘটায় আখেমেনীয়রা। যা বৈদেশিক বাণিজ্য জোরদার এবং ব্যাংকিং কার্যক্রমকে সহজতর করে। খৃস্টপূর্ব সপ্তম শতকের গোড়ার দিকে ব্যাবিলনের ইজিবি ব্যাংকের মতো এখানেও বহু বেসরকারি ব্যাংক গড়ে ওঠে। ব্যাবিলনের ব্যাংক থেকে পাওয়া রেকর্ডপত্রে দেখা যায়, এটি অন্যান্য কার্যক্রমের মধ্যে বন্ধকী ঋণ এবং নির্দিষ্ট সময়ে পরিশোধযোগ্য ঋণ (floating loan) বিতরণ করতো। পরবর্তীকালে নিপ্পুর এ প্রতিষ্ঠিত মুরাসশুর মতো আরেকটি ব্যাংক ইজারা দিতে, খাল খনন করে কৃষকদের কাছে পানি বিক্রি করতো।

২.৮. চীনে ব্যাংকিং

এ যাবত চীনের প্রথম যে রাজবংশের কথা জানা যায়, তা হলো জিয়া রাজবংশ। যদিও এর অস্তিত্ব এখন পর্যন্ত প্রতœতাত্ত্বিক প্রমাণের ভিত্তিতে স্পষ্ট হয়নি। ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে প্রত্মতত্ত্ববিদরা হেনান উপত্যকায় প্রাচীন শহর, ব্রোঞ্জের অস্ত্রশস্ত্র ও সমাধি আবিস্কার করেন। চীনা সভ্যতার প্রাচীন শান যুগের সাক্ষ্য বহন করছে এগুলো। খৃস্টপূর্ব ১৫২৩-১০২৭ সাল পর্যন্ত মোটামুটি এই রাজবংশের শাসন টিকে ছিল। এই সভ্যতা ছিল কৃষিভিত্তিক। শিকার ও পশুপালনের মধ্য দিয়ে এর সমৃদ্ধি ঘটে (ফিন্ডলিং এন্ড থ্যাকারে, ২০০১:১২-১৩)। কড়ি এবং মূল্যবান ধাতব অস্ত্রশস্ত্র যেমন বর্শা, কুঠার ও ছুরি বাণিজ্যিক বিনিময় উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হতো (ডাভিয়েস, ২০০২:৫৫)। ইতিহাসবিদদের মতে, এই যুগের আগে অবস্থা কেমন ছিল তা নিয়ে কিংবদন্তিগুলো থেকে বাস্তবতাকে আলাদা করা কঠিন। এই যুগে সেখানে উঁচু স্তরের সভ্যতার প্রমাণ হিসেবে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা উল্লেখ করা যায়। এর একটি হলো লিখন পদ্ধতি আবিষ্কার। চীনারা কচ্ছপের খোল ও পশুর হাড়ে লিখতো। অন্য ঘটনাটি ছিল ব্রোঞ্জ ধাতুর ব্যবহার (কলাম্বিয়া এনসাইক্লোপেডিয়া, ২০০১:১০০৪৫)।

খৃস্টীয় সপ্তম শতকের দিকে চীনে প্রথম কাগুজে মুদ্রার প্রচলন ঘটলেও ৯৬০ খৃস্টাব্দের আগে এর ব্যবহার ছিল সীমিত। মুদ্রা তৈরির জন্য তামার ঘাটতি দেখা দিলে চীনা সম্রাট প্রথম সাধারণভাবে নোট-এর প্রচলন করেন। মূল নোটগুলো নির্দিষ্ট এলাকা ও মেয়াদের জন্য চালু ছিল। সম্রাট হিয়েন সাং (৮০৬-৮২১ খৃস্টাব্দ) এর সময়ে এ ধরনের কাগুজে মুদ্রা চালুর পেছনে কারণ ছিল ধাতব মুদ্রা তৈরির জন্য তামার ঘাটতি। চীন থেকে মুদ্রা বিভিন্ন স্থানে ছাড়িয়ে পড়ে। এর আংশিক কারণ ছিল উত্তর থেকে আসা হানাদারদের কাছ থেকে রেহাই পেতে তাদেকে কাগুজে মুদ্রা পণ দেয়া হতো। ফলে, এই মুদ্রার ওপর মানুষের নির্ভরতা বেড়ে যায়। ১০২০ খৃস্টাব্দ নাগাদ বিপুল পরিমাণ কাগুজে মুদ্রা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এতে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। এর পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে বেশ কয়েক দফা চরম মুদ্রাস্ফীতির ঘটনা ঘটে। ফলে, কাগুজে মুদ্রা প্রচলনের প্রায় ৫০০ বছর পর, ১৪৫৫ খৃস্টাব্দের দিকে চীনারা এই মুদ্রা পরিত্যাগ করে (উইকিপিডিয়া ওয়েবসাইট)।

৩. মুসলিম সাম্রাজ্যে ব্যাংকিং

ইসলামের উন্মেষ থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত
হোমুদের মতে (১৯৮৫:১৯) “রোম সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকে ইসলাম আগমনের পূর্ব পর্যন্ত যুগটি ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। এ সময়টি ছিল মানুষের জানা ইতিহাসের সবচেয়ে দুনীতিপূর্ণ এবং অস্থিতিশীল একটি অধ্যায়। ইসলামের আগমন জীবনের ওপর থেকে অন্ধকার দূর করে এবং ইসলামের ছায়াতলে আসা এলাকায় সৃষ্টি হয় নিরাপদ ও স্থিতিশীল পরিবেশ।” ইসলামের উত্থান অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও বিচার সকল ক্ষেত্রে অভাবনীয় পরিবর্তন আনে এবং এক নতুন সভ্যতার বিকাশ ঘটায়। যার ভিত্তি ছিল আল্লাহ ও তার নির্দেশের
(Shari'ah) প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পন। উইলসন (১৯৫০:৪০-৫৩) বিশ্বের ইতিহাসে ইসলামের প্রভাব বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেন: “সপ্তম শতকে আরব (মুসলমান) জনগণের আকস্মিক উত্থান ছিল ইতিহাসের এক অনন্য ঘটনা। কিছু স্থায়ী বসতি, কিছু যাযাবর, বাণিজ্য ও নিতান্ত সাধারণ মানের কৃষি কাজ করে জীবন ধারণকারী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু গোত্রের সম্মিলন, তিন প্রজন্মের মধ্যে নিজেদেরকে একটি সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী সাম্রাজ্যে পরিণত করে। ভূমধ্যসাগরের গোটা দক্ষিণভাগ এবং আফগানিস্তান থেকে স্পেন পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তারা আধিপত্য বিস্তার করে। বিচিত্র বিশ্বাস ও ভাষাভাষীর জনগোষ্ঠীকে অভিন্ন ধর্ম, অভিন্ন ভাষা ও অভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভিত্তিতে গড়ে ওঠা একটি  সমাজে ঐক্যবদ্ধ করতে সফল হয় তারা। লিয়েবার (১৯৬৮:২৩০) আরো বলেন : “খৃস্টীয় সপ্তম শতকের পর থেকে মুসলমানরা দীর্ঘ যাত্রার ব্যবসা এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে এতটাই সফল হয় যে, তা আগের জানা সব কিছুকে ছাড়িয়ে যায়। এটা সম্ভবত এ কারণে হয়েছিল যে, ইসলাম এমন এক মহান ধর্ম, যেখানে ব্যবসায়ীদেরকে সমাজের অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ স্থানে অধিষ্ঠিত করা হয়েছে” এবং কোন ব্যবসায়ী যদি সততা, ন্যায্যতা এবং জনকল্যাণে কাজ কওে, তাহলে বেহেশতে তাকে অত্যন্ত উঁচু মর্যাদার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। তাই, অনেক বড় বড় মুসলিম মনীষী জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে ব্যবসা করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করেছেন (দেখুন, ওয়েইট ১৯৫৫)।

লিয়েবার (১৯৬৮:২৩০) দেখান যে: “প্রতিবছর সারা বিশ্ব থেকে হজ্জ ও অন্যান্য উপলক্ষ্যে আরবে মানুষের সমবেত হবার যে রেওয়াজ, বিশেষ করে সে কারণে মুসলমানদের মাঝে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে। সউদি আরবে আসা অনেক মুসলমান তাদের ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা পালনের পাশাপাশি নিজ দেশে উৎপাদিত পণ্য, যাতায়াত পথের বিভিন্নস্থানে কেনাবেচা করতেন। দেশে ফেরার সময় ভালো অংকের মুনাফার আশায় বিদেশী পণ্য নিয়ে যেতেন তারা।” ব্যবসা প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকিং কার্যক্রমেরও বিকাশ ঘটে। ফলে সউদি আরবে ঋণ দেয়া, ধার নেয়া, হস্তান্তর, নিশ্চয়তা প্রদান, নিরাপত্তা দান ইত্যাদি কর্মকা- ব্যাপকভাবে চালু হয়।

ডি রুভার (১৯৫৪:৪৩) এক বক্তব্যে বলেছিলেন “ব্যাংক না থাকলে কোথাও ব্যাংকিং হতে পারে না”। এর পরিপ্রেক্ষিতে উদোভিচ (১৯৭৯:২৫৫) যুক্তি দেন: “মধ্যযুগের ইউরোপের ক্ষেত্রে এ কথা ঠিক। কিন্তু, মধ্যযুগের মুসলিম বিশ্বের ক্ষেত্রে এ কথা একেবারেই সঠিক নয়। মধ্যযুগের বিভিন্ন সাহিত্য এবং বহু প্রামাণ্য দলিলের তথ্যে আমরা ব্যাংকারদের দেখতে পাই। তবে, ব্যাপক ও শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত ব্যাংকিং কার্যক্রমের দেখা পেলেও আমরা কোন ব্যাংকের দেখা পাই না। এর মানে, পুরোপুরি না হলেও অর্থ নিয়ে প্রধান কারবার ছিল এমন কোন স্বায়ত্তত্বশাসিত বা আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান আমরা চিহ্নিত করতে পারি না। 

তবে, আল-ক্বালক্বাশান্দি (১৯১৩), আল-জাশিইয়ারি (১৯৩৮), পেল্লাত ও শাসট (১৯৬৫), আল-কুবাইশি (১৯৭৯), আল-আলি (১৯৫৩, ১৯৮১), আল-সা’দি (১৯৮৫), আল-দুরি (১৯৮৬, ১৯৯৫), ফিশেল (১৯৯২), আল-হামদানি (২০০০) এবং চাপরা ও আহমেদ (২০০২) তাদের ইতিহাস লেখায় দেখান, সে সময় ব্যাংকারদের সারাফিন বা সায়ারিফাহ বা জাহাবিধাহ এবং ব্যাংককে দাওয়াউইন আল-জাহাবিধাহ বলা হতো।

অষ্টম শতকের শেষ দিক থেকে আর্থিক হিসাব-নিকাশ করেন এমন ব্যক্তিকে বোঝাতে জাহবাধ (বহুবচন জাহাবিধাহ) শব্দটি ব্যবহৃত হতো। আব্বাসীয় খেলাফতের যুগে সুপরিচিত সরকারি অনুমতিপ্রাপ্ত মার্চেন্ট ব্যাংকাদেরও ছিল এই উপাধি। এরা ছিলেন, মুদ্রা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, মুদ্রার নিপুন পরীক্ষক, রাজস্ব গ্রহণকারী, সরকারি কোষাধ্যক্ষ, মুদ্রা বিনিময়কারী ও সংগ্রাহক। ৯১৩ খৃস্টাব্দের দিকে, রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় দিওয়ান আল-জাহবিধাহ (বহুবচন দিওয়াউইন আল-জাবিদাহ)। প্রধান প্রধান বাণিজ্য শহরগুলোতে এর শাখা ছিল। কোন রকম সুদী লেনদেন ছাড়াই আধুনিক ব্যাংকিং-এর প্রায় সব কাজ সম্পাদিত হতো এখানে। খলিফা আল-মুকতাদির (৯৮০-১০৩২ খৃস্টাব্দ) এর সময় আল-জাবদাহ’র ভূমিকা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং তিনি একজন আধুনিক ব্যাংকার হিসেবে আবির্ভূত হন যে, তাকে আমানত ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালনের বাইরেও সাক (চেক) ও বিশেষ করে সাফতাজাহ (বিল অব এক্সচেঞ্জ) এর মাধ্যমে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে তহবিল পাঠানোর কাজ করতে হতো। খলিফা, উজিরসহ দরবারের অন্যান্য কর্মকর্তাকে বিপুল পরিমাণে ঋণ মঞ্জুর করতে হতো তাকে (আল-ক্বালক্বাশান্দি ১৯১৩; আল-জাসহিইয়ারি, ১৯৩৮, পেল্লাত ও শাসাট ১৯৬৫ এবং মেতওয়াল্লি ও সাহাতা, ১৯৮৩)। 

মেতওয়াল্লি ও সাহাতার (১৯৮৩:১১৩-১৭) মতে, প্রধান জাবদাহ বা দিওয়ান আল-জাবিদাহ’র প্রশাসককে সকল আয় ব্যয়ের মাসিক ও বার্ষিক বিবরণী তৈরি করতে হতো। একে বলা হতো আল-খাতমাহ (আর্থিক বিবরণী বা ব্যালেঞ্চ শিট)। ইতিহাসে দেখা যায়, অনেক জাহাবিদাহ ছিলেন খৃস্টান বা ইহুদি। যদিও তাদের মর্যাদা ছিল ধিম্মি (মুসলিম সমাজে বসবাসকারী অমুসলিম) হিসেবে। ঐতিহাসিক সূত্রগুলো থেকে জাহাবিদাহ’র যে তালিকা পাওয়া যায়, তাদের মধ্যে ছিলেন: ইব্রাহিম বিন ইউহান্না, জাকারিয়া বিন ইউহান্না, সুলাইমান বিন ওহাব, ইব্রাহিম বিন আহমাদ, ইসরাইল বিন সালিহ এবং সর্বোপরি বাগদাদের দুইজন ইহুদি বণিক ও ব্যবসায়ী : ইউসুফ বিন ফিনকাস ও হারুন বিন ইমরান। শেষের দু’জনকে পারস্যের আহওয়াজ প্রদেশের জাবদাহ দফতরে নিয়োগ দেয়া হয়। পরে তারা খলিফা আল-মুকতাদির-এর জাবিদাত আল-হাদরাহ (ব্যাংকার পরিষদ) ও উজির নিযুক্ত হন (দেখুন, মেজ ১৯৩৭; গোইতিন ১৯৬৭, ১৯৭৩; উদোভিচ ১৯৭০, ১৯৭৯ এবং আল-সাইয়্যেদ ১৯৮৪)। 

চাপরা ও খান (২০০০:১-৩) এবং চাপরা ও আহমদ (২০০২:২-৬) লিখেছেন, ইসলামের ইতিহাসের একেবারে শুরু থেকেই মুসলমানরা, উৎপাদনমুখী কার্যক্রম পরিচালনা ও ভোক্তার প্রয়োজন পূরণের জন্য সম্পদ সমাবেশের একটি আর্থিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। এই ব্যবস্থা ছিল সুদবিহীন। এটা ছিল প্রধানত মুদারাবাহ (পরোক্ষ অংশীদারিত্ব) এবং মুশারাকাহ (প্রত্যক্ষ অংশীদারিত্ব)’র মতো লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে। এসব ব্যাংকার, মুদ্রার যথার্থতা এবং কতটুকু খাঁটি তা মূল্যায়ন করতেন। তখন মূল্যবান ধাতু দিয়ে মুদ্রা তৈরী হতো বিধায় এ কাজটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারা লেনদেন এর সময় বারবার গুনে দেখার ঝক্কি-ঝামেলা থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে, নির্দিষ্ট সংখ্যক মুদ্রা নির্দিষ্ট মাপের থলেতে রাখতেন। বস্তুগত পরিবহণ ছাড়াই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তহবিল স্থানান্তর করতেন তারা। এতে কেবল নিরাপত্তাই নিশ্চিত হতো না, পরিশোধ ব্যবস্থাও সুন্দরভাবে কাজ করতো।
আল-জাহাবিদাহ রাষ্ট্রকে আগাম ঋণ দিতো। সরকারের কর রাজস্বের মাধ্যমে এই ঋণ ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা ছিল। আল-জাহাবিদাহ এই রাজস্ব সংগ্রহ করতো। তারা কর রাজস্ব সংগ্রহের পর তাদের মূল অর্থ এবং এর ওপর বাড়তি কিছু ফেরত পেতো। কিছু কিছু ইতিহাসবিদ একে সুদ বলে মনে করেন (দেখুন, পেল্লাত ও শাসাট ১৯৬৫:৩৮৩)। কিন্তু, আমরা যদি কর সংগ্রহ ও এর ব্যবস্থাপনার পেছনে দেয়া পরিশ্রমের কথা বিবেচনা করি তাহলে বুঝা যাবে যে, মূলের ওপর এই বাড়তি অর্থ কোন সুদ ছিল না। এটা ছিল কর ব্যবস্থাপনার জন্য একটি ফি বা ‘পারিতোষিক’র মতো। কারণ, একদিকে ইসলাম সুদ অনুমোদন করে না অন্যদিকে, সুদ নির্ভর করে পরিমাণ ও মেয়াদের ওপর। কিন্তু, সেবা প্রদানের বিনিময়ে ‘পারিতোষিক’ নেয়ার অনুমতি রয়েছে। উদোভিচ জোর দিয়ে বলেন: “যদিও বণিক ও অন্যদের জন্য তাদের অর্থের একটি অংশ মার্চেন্ট ব্যাংকারদের কাছে সঞ্চয় রাখা বাধ্যতামূলক ছিল এবং মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো তাদের অর্থ বিভিন্ন পরিমাণে অন্যান্য মার্চেন্ট ব্যাংকে আমানত রাখতো, আমানতকারীকে কোন সুদ বা অন্যান্য ধরনের লাভ দেয়ার নজির নেই।” এর কারণ, আল্লাহ রিবা (সুদ) নিষিদ্ধ করেছেন। আল-কোরআনে এ ব্যাপারে অনেক আয়াত রয়েছে। পাশাপাশি, সেখানে রিবা এড়ানো যায় এমন অনেক বিকল্প মুশারাকাহ, মুদারাবাহ, মুজারা’হ  ইত্যাদি উল্লেখ রয়েছে।

মধ্যযুগের শুরুতে ইসলামী শাসন, একটি অর্থনৈতিক স্বর্ণযুগের ভিত্তি স্থাপনে বিশাল ভূমিকা পালন করে। তখন বাণিজ্য ও ব্যাংকিং খাতের খেলোয়াড়রা ছিলো আরব, পারসিয়ান, বারবার (উত্তর আফ্রিকার অধিবাসী), ইহুদি, খৃস্টান ও আর্মেনিয়ানরা। ইসলামী বণিকরা আল-আন্দালুস (স্পেন) থেকে চীন সাগরের উপকূল পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলো। পিরেনির মতে (১৯৩৭:৪৯): “বিশ্বব্যাপী তাদের বাণিজ্য সম্পর্কের কারণে, তারা (মুসলমান) ভারত থেকে আখ, সিসিলি ও আফ্রিকা থেকে তুলা এবং সিসিলি ও স্পেন থেকে চাল আমদানি করতো। তারা চীনাদের কাছ থেকে রেশম ও কাগজ তৈরি করতে শেখে এবং এই জ্ঞান মুসলিম সাম্রাজ্যের সবখানে পৌঁছে দেয়।”

লিয়েবার আরো লিখেন (২৯৬৮:২৩০): “ইতালি ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের বণিকরা ব্যবসার সুক্ষ্ম কৌশলগুলো ব্যবহারের প্রথম শিক্ষা, ভূ-মধ্যসাগরের অপর পাশে তাদের প্রতিপক্ষদের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। এদের বেশিরভাগ ছিল মুসলমান। ইহুদি ও খৃস্টানও কিছু ছিল। ইউরোপের বিপুল সংখ্যক শব্দের উৎপত্তিস্থল নিকট প্রাচ্য, প্রধানত আরামিক, আরবি ও পারসিয়ান হওয়ার মূল কারণ এটাই। ব্যবসায়িক কর্মকা-ের পরিভাষাগুলোর মধ্য দিয়ে মধ্যযুগের ইউরোপে তার প্রবেশ ঘটে। এসব পরিভাষার কিছু উদাহরণ হলো (মূল শব্দটির মতো করেই ইউরোপে উচ্চারিত হতে হবে তা নয়): দেওয়ান, আরসেনাল, ম্যাগাজিন, ট্রাফিক, ট্যারিফ, রিস্ক, ফোন্ডাকো, সেনসালি, গ্যালিয়া, আভাল ও মাওনা”।

ইংরেজি শব্দ চেক এর কথা উল্লেখ করার যেতে পারে, যা এসেছে আরবি সাক শব্দ থেকে; ক্বর্দ শব্দ থেকে এসেছে ক্রেডিট; রিজ্ক থেকে রিস্ক; ফরাসি শব্দ এখেতার এসেছে ইশতারা (কেনা) থেকে; আল-মাখজেন থেকে লে ম্যাগাসিন; হাওয়ালা থেকে আভাল এবং স্পেনিশ শব্দ আলমাসিন এসেছে আল-মাখজেন থেকে; সাউক (বাজার) থেকে জোকো এবং এমন আরো অনেক শব্দ (দেখুন দোই ১৯৮৪:৩৯৯; ভিভেস ১৯৬৯:১১৯-২০; টোরে ১৮৯২, স্টিগহার ১৯৬৩, বেনতার, ১৯৭১)। লাবিব (১৯৬৯:৮০) যেমনটা দেখিয়েছেন:“যেখানে ইসলাম প্রবেশ করেছে, সেখানেই ব্যবসায়িক কর্মকা- জোরদার হয়েছে, পণ্য বিনিময় বৃদ্ধি পায় এবং ঋণ পদ্ধতির বিকাশে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বানতিয়ার (১৯৭১:৭২) আরো দেখান: “জানা বিশ্বের সবখানে আরব বাণিজ্য ছড়িয়ে পড়ে। চীন, মালয়েশিয়া ও ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল।”
উদোভিচের (১৯৭৯:২৬৩) মতে : “সাফতোজা (বিল অব এক্সচেঞ্জ) সবসময়ের জন্য এবং হাওয়ালা (ঋণ গ্যারান্টি বা ঋণ হস্তান্তর) সাধারণভাবে একটি লিখিত বাধ্যবাধকতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। মধ্যযুগে নিকট প্রাচ্যে এগুলো ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ঋণপত্র।” এটা হয়েছিল সম্ভবত: আল্লাহ আল-কোরআনের সবচেয়ে দীর্ঘ আয়াতে (২:২৪২-৩) নির্দেশ দিয়েছেন, সবধরনের বাধ্যবাধকতা লিখে রাখার জন্য।

১৩শ শতাব্দির পর ইসলামী খেলাফতের ধীর ও দীর্ঘ পতনের প্রকৃয়ায় রাষ্ট্রীয় ব্যাংকার হিসেবে
জাবদাহ ব্যাপকভাবে গুরুত্ব হারায়। এর কার্যক্রম কেবল সারাফ বা সায়রাফি (মুদ্রা বিনিময়কারী) পর্যায়ে নেমে আসে। এর পেছনে যেসব বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উপদান কাজ করেছে সেগুলো হলো:
১.    বিশেষ করে রাজনৈতিক পরিমন্ডলে ইসলাম ও ইসলামিক শরিয়াহ থেকে ক্রমেই সরে আসা।
২.    রাষ্ট্রের সঙ্গে জড়িতদের অসংযমী ও বিলাসবহুল ব্যয়।
৩.    সংগঠনের অভাব এবং মাথাভারী প্রশাসন।
.    রাজনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়া, প্রত্যন্ত প্রদেশগুলোর ওপর কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব হারানো এবং ছোট ছোট শাসক বংশ এবং আধা-স্বাধীন গভর্নরদের উত্থান। যার ফলে খলিফারা তাদের মন্ত্রী ও সেনাপতিদের হাতের পুতুলে পরিণত হন।
৫.    পরস্পরের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন বিভিন্ন গোষ্ঠী যেমন, সুফি, শিয়া, ইসমাইলিয়া, দ্রুজ, ইত্যাদি’র উদ্ভব। এদের সবাই খাঁটি মুসলমান হওয়ার দাবি করে।
৬.    ক্রুসেডার, মোঙ্গল এবং তাতারদের সঙ্গে দীর্ঘ যুদ্ধ। ফলে, ইরাক ও সিরিয়ার বেশিরভাগ এলাকা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়।
৭.    প্রায় তিন শতাব্দী ধরে চলা তুর্কি-পারস্য যুদ্ধ। যা ইরাকের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে বাধাগ্রস্ত করে।
উপরোক্ত এবং অন্যান্য ঐতিহাসিক কারণে মুসলিম বিশ্বের প্রকৌশলগত ও অর্থনৈতিক কর্মকা- স্তিমিত হয়ে পড়ে। এছাড়াও ইসলামী অর্থব্যবস্থার অনেক প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত হয়ে তার জায়গায় পশ্চিমা প্রতিষ্ঠান জন্ম নেয় (ইসাবি, ১৯৬৬:৪, লিউস, ১৯৭০:১০২ এবং চাপরা, ২০০০:১৭৩-১৮৫, এবং চাপরা ও খান, ২০০০:৩)।

৪. ইউরোপে ব্যাংকিং

রোমান সাম্রাজ্যের পতন থেকে খৃস্টীয় দ্বাদশ শতক পর্যন্ত
৩০০ খৃস্টাব্দে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকে ১৩০০ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত স্পেন ও ইতালি ছাড়া ইউরোপের বাকি অঞ্চল এক হতাশ ও অন্ধকারাচ্ছন্ন সময় পার করে। যা ইতিহাসে ‘অন্ধকার যুগ’ হিসেবে পরিচিত। ইসলামী সাম্রাজ্যের অধীনে আল-আন্দালুস নামে পরিচিত স্পেনে ৮ম শতাব্দী থেকে ১৫শ শতাব্দী পর্যন্ত এক মহা সভ্যতার বিকাশ ঘটে। আর ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে কৌশলগত বাণিজ্যিক অবস্থানে থাকা ইটালির সঙ্গে ইসলামী বিশ্বের মুসলমান, খৃস্টান ও ইহুদি বনিকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হতো। এমনকি এক সময় মুসলিম অংশ ছিল সিসিলি ও ভেনিস।
রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর পশ্চিম ইউরোপে বহু বর্বর রাষ্ট্রের জন্ম হয়। গভীর পশ্চাদপদতায় নিমজ্জিত হয় পশ্চিম ইউরোপের বাণিজ্য। হোমার (১৯৬৩:৮৪) এর বর্ণনা মতে: “অর্থনীতি ব্যাপকভাবে কৃষিনির্ভর হয়ে পড়ে।” যার কারণে ইউরোপের খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ পিরেন্নি পশ্চিম ইউরোপ সম্পর্কে বলতে বাধ্য হয়েছেন (১৯৩৭:২০):
La terre était tout et le commerce rien,, যার অর্থ ভূমিই (বা কৃষি) ছিল সব। বাণিজ্য কিছুই ছিল না। এর মানে এই নয় যে, পশ্চিম ইউরোপে কোন ধরনের বাণিজ্য হতো না। এখানে বলা হচ্ছে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অনিশ্চয়তা, উচ্চ পরিবহণ ব্যয়, উচ্চ কর ও শুল্ক, চোরাচালান, ঘুষ ও অজ্ঞতার কারণে তখন বাণিজ্যিক কর্মকান্ড ছিল নগণ্য। আর, বাণিজ্য সীমাবদ্ধ হয়ে পড়লেও ব্যাংকিং কার্যক্রমও সে পথেই অগ্রসর হবে।

হোমার (১৯৬৩:৮৪)  লিখেছেন কথিত সেই ‘অন্ধকারযুগে’: “ল্যাতিন ভাষা হারিয়ে গেলো, উধাও হলো সংস্কৃতি, চরম বিস্তৃতি ঘটলো কুসংস্কারের। তবে, কৃষ্ণ যুগের সবচেয়ে অন্ধকার সময়টিতেও নিয়মিতভাবে মুদ্রা ব্যবহৃত হলেও বাণিজ্য না থাকায় এর লেনদেন সীমিত হয়ে পড়ে।” অরসিঙ্ঘার (১৯৬৭:১১) দেখান যে: “রোমান সাম্রাজ্য পতনের পর থেকে একাদশ শতকের শেষ পর্যন্ত পুরো সময়টিতে পশ্চিম ইউরোপে ব্যাংকিং শিল্প বলতে ছিল কেবল মুদ্রা বিনিময়। মধ্যযুগের দ্বিতীয়ভাগে ক্রুসেডারদের যুগ হলো অর্থ ও ঋণ ব্যবস্থা বিকাশের সূচনা বিন্দু।” দশম শতাব্দীকে বলা হয় ক্রান্তিকাল। আগে থেকেই বিভিন্নস্থানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন বা আধা-স্বায়ত্তশাসিত রাজ্যের উদ্ভব ও অন্যান্য কারণে দুর্বল হয়ে পড়া মুসলিম সাম্রাজ্য, মোঙ্গল ও তাতারদের অব্যাহত হামলার কারণে আরো দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে একদিকে ক্রুসেডাররা মুসলিম সাম্রাজ্যকে আরো দুর্বল করতে থাকে এবং অন্যদিকে, মুসলিম সভ্যতা থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞান, বিশেষ করে, কিভাবে সেচ বাড়ানো যায়, হস্তশিল্প, অংশীদারিত্ব, বাণিজ্য ও ব্যাংকিং পশ্চিম ইউরোপে স্থানান্তর হতে থাকে। যার ফলে একবিংশ শতকের শেষ দিক থেকে সাধারণভাবে পশ্চিম ইউরোপে এবং বিশেষভাবে ইতালিতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উত্থান ঘটতে শুরু করে। 

তাই, লোপেজ (১৯৫২:২৭৩) বিষয়টি বর্ণনা করেছেন এভাবে: “অবশেষে ইতালি তার ইউরোপ মহাদেশ ও ভূ-মধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যবর্তী অবস্থানের সুযোগটিকে কাজে লাগাতে শুরু করে। মাঝারি গোছের সফল কৃষক ও খামারিদের এই জাতি, রোমান যুগে বাণিজ্যের জন্য পূর্বাঞ্চলের ওপর নির্ভরশীল ছিল। তারা তাদের জনবহুল হয়ে পড়া রাজধানীর খাদ্য চহিদা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছিল। তাই বিশ্বের প্রথম বাণিজ্যিক ও শিল্পভিত্তিক জাতি হওয়ার পথই কেবল খোলা ছিল তাদের সামনে।”
সেসময় সম্ভবত ভেনিস ছিল সবচেয়ে সমৃদ্ধ নগরী। সেখানে কোন ভূমিদাস
(serfdom) ছিলো না এবং পোপের বিরোধিতা সত্ত্বে¡ও সেখানকার বেশিরভাগ মানুষ সমুদ্র পথে, বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্যে জড়িত ছিল। মুদ্রা ও অর্থ বিনিময়কারীদের শক্তি ও মর্যাদা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। তখন ভূমধ্য সাগরীয় অঞ্চলের বাণিজ্যে ইসলামি অংশীদারিত্ব চুক্তি মুদারাবাহ’র মতো পরোক্ষ অংশীদারিত্বমূলক ব্যবস্থা কমান্ডা
(commenda) বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে (দেখুন, হোমার, ১৯৬৩:৮৬-৮৮ এবং মিসকিমিন, ১৯৬৯:১১৮)। লিয়েবার তার পর্যবেক্ষণে (১৯৬৮:২৩০) সম্ভবত বিষয়টিকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন: “ইটালির বণিকরা ব্যবসার সুক্ষ্ম কৌশলগুলো ব্যবহারের প্রথম শিক্ষা ভূ-মধ্যসাগরের অপর পাশে তাদের প্রতিপক্ষদের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। এদের বেশিরভাগ ছিল মুসলমান। ইহুদি ও খৃস্টানও কিছু ছিল।”

বিষয়টি এভাবেও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, হামুদ (১৯৮৫:২৪) দেখান, ব্যাংকের উৎপত্তির ধারণায় ১১৫৭ খৃস্টাব্দে ভেনিসে স্থাপিত প্রথম ব্যাংকের নামকরণটি গুরুত্ব পেয়েছে। আর ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরুর দিনক্ষণ নিয়ে সাধারণ ধারণাটি লামবারদিয়া’র মুদ্রা বিনিময়কারীদের সঙ্গে জড়িত। তারা একটি কাঠের টেবিলের পেছনে বসে কাজ চালাতো। এই টেবিলগুলোর নাম ছিল বাংকো। তাই, লোপেজ (১৯৫২:২৯১) মন্তব্য করেন: “ইতালি ছিল মধ্যযুগীয় অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ায়, আর ইংল্যান্ড ছিল আধুনিকতার পথে। শিল্প বিপ্লব প্রথম ইংল্যান্ডের কিছু এলাকার অর্থনীতি ও সমাজকে বদলে দেয় এবং পরে তা বিশ্বের অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু, বাণিজ্য বিপ্লব (ব্যবসা ও ব্যাংকিং) প্রথম ইতালির কয়েকটি শহরে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে তা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে।”

৫. ইসলামি সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকে বিংশ শতকের মাঝামাঝি ‘ইসলামি ব্যাংকিং’ আবির্ভাবের
পূর্ব পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বে ব্যাংকিং
১১শ শতাব্দিতে ইসলামী সাম্রাজ্যের পতন শুরু হওয়ার পর থেকে বিংশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত কয়েক শতাব্দি ধরে দীর্ঘ এক অবক্ষয় ও অবনতিশীল অবস্থার মধ্যে পার করে মুসলিম বিশ্ব। এই যুগটি উসুর-আল-ইনহিতাত বা ‘অবনতির যুগ’ হিসেবে ইতিহাসে পরিচিতি লাভ করে। রোমান সাম্রাজ্য পতনের পর থেকে ১২শ’ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত পশ্চিম ইউরোপে যেমন ‘অন্ধকার যুগ’ বিরাজ করে, এটাও ঠিক তেমনি। রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক, সাংস্কৃতিক--জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এই অবক্ষয় দেখা দেয়। এর ক্ষতিকর পরিণতি ছিল বিপর্যয়কর:

-এক সময়ের ঐকবদ্ধ খেলাফত ছোট ছোট অসংখ্য আঞ্চলিক শক্তিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এসব শক্তি পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। স্বৈরশাসন, প্রজা উৎপীড়ন ও অবিচার ব্যাপকভাবে ছাড়িয়ে পড়ে। ফলে মোঙ্গল, তাতার, ক্রুসেডারসহ অন্যদের জন্য মুসলিম বিশ্বে হানা দেয়া সহজ হয়ে পড়ে। তারা মুসলিম রাজ্যগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার এবং অনেকগুলোকে কলোনিতে পরিণত করে।
-শরিয়াহ ভিত্তিক এক সময়ের ন্যায়পরায়ণ ও ভারসাম্যপূর্ণ ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা সামরিক সামন্ততান্ত্রিক সমাজে পরিণত হয়। যা অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের সহায়ক ছিল না।

--দরিদ্র, দুস্থ, বৃদ্ধ ও শিশুদের পরিচর্যায় নিবেদিত বায়তুল মাল (কোষাগার) গভর্নর, উজির, সেনাপতি ও  কর আদায়কারীদের একচেটিয়া সম্পত্তিতে পরিণত হয়। ফলে, সাধারণ মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলে। তারা নির্যাতন, অবিচার, হত্যা বা সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের শিকার হওয়া থেকে বাঁচতে সমৃদ্ধ নগরকেন্দ্র কেন্দ্র ছেড়ে গ্রাম্য পাহাড়ি এলাকায় চলে যায়। তাদের মধ্যে অজ্ঞতা, অশিক্ষা, কুসংস্কার, রহস্যবাদ, মূর্তিপুজা, ইত্যাদি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে (দেখুন, ইসাবি, ১৯৬৬:৪)।

--দশম শতকের তুলনায় কৃষিকাজ সংকুচিত হয়ে নগন্য পর্যায়ে নেমে আসে। পাশাপাশি, জনসংখ্যা ব্যাপকভাবে কমতে শুরু করে। জমি বরাদ্দ দেয়া হতো কর্মকর্তাদের অথবা তারা নিজেই নিয়ে নিতো। কৃষি পদ্ধতি অপরিবর্তিত থেকে যায়। সম্ভবত, ১৯৬০ এর দশকের পূর্ব পর্যন্ত বেশিরভাগ কৃষক লোহার বদলে কাঠের লাঙ্গল ব্যবহার করতো। এর ফলে শস্যের ফলন ছিল অত্যন্ত কম এবং ফসল ও গবাদিপশুÑদুটিই অব্যাহতভাবে খরা, পোকার আক্রমণ ও রোগের শিকার হতো (দেখুন, লুইস, ১৯৭০: ১০৫, ১১৩ এবং ইসাবি, ১৯৬৬: ৩, ২১, ৬৫)।
-ঔপনিবেশিকদের নিয়ে আসা ইউরোপীয় কলের-তৈরি ভোগ্যপণ্যের বন্যা স্থানীয় হস্তশিল্পের ওপর চরম আঘাত হানে। পরবর্তী কয়েক শতাব্দীতে এই হস্তশিল্পের একটি বড় অংশের বিলুপ্তি ঘটে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শিল্প পণ্যের সঙ্গে কয়েক শতক আগে তৈরি হস্তশিল্পের তুলনা করলে বুঝা যাবে যে, এগুলোর উৎপাদন কেবল থেমেই যায়নি বরং উল্টোদিকে চলতে শুরু করে (ইসাবি, ১৯৬৬: ১৮ ও ৪৬)।
-১১শ’ শতাব্দি থেকে বাণিজ্য মুসলমানদের কাছ থেকে ইউরোপীয়দের কাছে চলে যেতে শুরু করে। দ্রুত এরাই ভূ-মধ্য সাগরীয় অঞ্চলের প্রধান পণ্যবাহক ও ব্যবসায়ীতে পরিণত হয় (ইসাবি, ১৯৬৬:৭ এবং লেউইস, ১৯৭০:১১৪)।
ভোজেল ও হায়েস (১৯৯৮:১৯ ও ৪) লিখেন, ঊনবিংশ শতাব্দির মাঝামাঝি থেকে মুসলিম বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ নতুন প্রভাববিস্তারকারী পশ্চিমা বিশ্বের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ চাপের কারণে, বিশেষ করে প্রশাসন ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে পশ্চিমা ধাঁচের আইন ও আইনী ব্যবস্থা চালু করতে বাধ্য হয়। শত শত বছরের পুরনো ইসলামী অর্থব্যবস্থার চর্চা রাহুতে ঢাকা পড়ে। ইউরোপের প্রভাবে বেশিরভাগ দেশ পশ্চিমা ধাঁচের ব্যাংকিং পদ্ধতি ও ব্যবসা মডেল গ্রহণ এবং ইসলামী বাণিজ্যিক পদ্ধতির চর্চা পরিত্যাগে উৎসাহিত হয়। স্বাধীনতা লাভ, বিদেশী ব্যাংক জাতীয়করণ এবং দেশীয় ব্যাংকিং ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে বিদেশী ব্যাংকের আধিপত্যের অবসান ঘটে। কিন্তু, নতুন ব্যবস্থা এক ধরনের ‘নব্য-ঔপনিবেশিক’ ব্যাংকিং পদ্ধতি হয়ে ওঠে। এটা ঠিক, বিদেশী ব্যাংক জাতীয়করণ এবং নতুন দেশীয় ব্যাংকের প্রতিষ্ঠার ফলে এগুলো জাতীয় ব্যাংকে পরিণত হয় এবং তা জাতীয় স্বার্থ দেখভাল করে। কিন্তু, এগুলোর পরিচালনা পদ্ধতি বিদেশী ব্যাংকের মতোই থেকে যায় এবং এগুলো সুদের ভিত্তিতে কার্যক্রম চালাতে থাকে। অথচ এই ব্যবস্থা মুসলিম জনগণের বিশ্বাসের বিপরীত। ফলে, জন্ম নেয় ‘ইসলামী ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠার ধারণা। এই ব্যাংক, মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস ও চেতনা অক্ষুন্ন রেখেই গতানুগতিক সকল ব্যাংকিং সেবা দেবে। ‘ইসলামী ব্যাংক’ বা ‘সুদ-মুক্ত ব্যাংক’--যে নামেই একে অভিহিত করা হোক না কেন, তা ছিল ইসলামী পুনরুজ্জীবনের ফসল। এর সূচনা অনুসন্ধানে ১৯৩০, ১৯৪০ ও ১৯৫০ দশকের দিকে দৃষ্টি ফেরানো যেতে পারে। এ সময় ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে বেশ কিছু মুসলিম রাষ্ট্র স্বাধীনতা লাভ করে। 

ট্রাউট (১৯৮৩) এবং উইলসন (১৯৮৩) দেখান, ১৯৫০’র দশকের শেষভাগে পাকিস্তানের একটি গ্রামে প্রথম ইসলামী ব্যাংক স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। তবে, এর প্রভাব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কিছু ধর্মভীরু ব্যক্তি পরীক্ষামূলকভাবে একটি সুদ-মুক্ত ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। তারা সুদমুক্ত তহবিল সংগ্রহ করতেন এবং সেখান থেকে গরিব ভূমি মালিকদের কৃষিকাজের জন্য ঋণ দেয়া হতো। ঋণের জন্য কোন সুদ নেয়া হতো না। তবে, ব্যাংকের পরিচালনা ব্যায় নির্বাহের জন্য অল্পকিছু ‘ফি’ থাকতো। যাইহোক, উইলসন (১৯৮৩:৭৫) লিখেন : “যদিও ঋণ নেয়ার লোকের কোন কমতি ছিল না কিন্তু, ফেরত পাওয়া যাবে না ভেবে তহবিলদাতারা প্রতিষ্ঠানটিকে তাদের অর্থ একবারের জন্যই দিতেন। ফলে, শিগগিরই ব্যাংকটিতে তহবিল ঘাটতি দেখা দেয়। অধিকন্তু, ব্যাংক কিভাবে ঋণ বিতরণ করছে এসব বিষয়ে অতিমাত্রায় আগ্রহ দেখাতে লাগলেন তহবিলদাতারা। একদিকে, ব্যাংক কর্মকর্তাদের কাজের কোন স্বাধীনতা ছিলনা, অন্যদিকে, নতুন আমানত আসাও বন্ধ হয়ে গেলো। ব্যাংকে স্টাফ নিয়োগ নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। নগরীর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর লোভনীয় এবং নিরাপদ চাকরি ছেড়ে কেউ প্রত্যন্ত এলাকার এই অনিশ্চয়তার মধ্যে আসতে চাইতো না। ফলে, শিগগিরই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো এই উদ্যোগ। কিন্তু, পাকিস্তানে যখন এ উদ্যোগের সমাপ্তি ঘটে, ঠিক তখনই নতুন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হলো মিসরে।”
১৯৬৩ সালের ২৫ জুলাই মিসরের সুপরিচিত ব্যাংকার এল-নাজ্জার, প্রথমবারের মতো মিট-ঘামার প্রদেশে মিট-ঘামার ইসলামিক সেভিংস ব্যাংক (এমজিআইএসবি) প্রতিষ্ঠা করেন। এল-নাজ্জার পরবর্তীতে ইন্টরন্যাশনাল এসোসিয়েশন ফর ইসলামিক ব্যাংক-এর মহাসচিব হয়েছিলেন। একটি উন্নয়নশীল মুসলিম দেশের গ্রামীণ পরিবেশে এই ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি জার্মান সেভিংস ব্যাংকের মডেল গ্রহণ করেন। তার উদ্দেশ্য ছিল শরিয়াহ আইন লঙ্ঘন না করে মিসরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের কাছে অলস পড়ে থাকা অর্থ সংগ্রহ এবং ওই সঞ্চয়ের জন্য তাদেরকে হালাল মুনাফা প্রদান। এল-নাজ্জার ছিলেন একজন অভিজ্ঞ পেশাজীবী, কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করার বদৌলতে কিছু ব্যাংকিং অভিজ্ঞতাও তার ছিল। আগ্রহী মুসলমানদের মধ্য থেকে সতর্কতার সঙ্গে কর্মচারী বাছাই করে ব্যাংকটি পরিচালনা শুরু করেন তিনি। “ব্যাংকের স্টাফরা অল্প সময়ের মধ্যে রক্ষণশীল দেশটির জনগণের আস্থা অর্জনে সমর্থ হয়। এসব কর্মচারী তাদের সম্ভাব্য গ্রাহকের সঙ্গে এক কাতারে শামিল হয়ে ধর্মীয় অনুশাসন পালন করতেন। এলাকার কৃষকরা বহিরাগতদের ব্যাপারে ছিল সন্দিহান এবং তাদের খুব কম সংখ্যকই বাণিজ্যিক ব্যাংকে লেনদেন করতো। সেগুলোকে তারা, পশ্চিমাপন্থী মিসরীয়দের স্বার্থ রক্ষাকারী ভিনদেশী প্রতিষ্ঠান বলে মনে করতো। কিন্তু, এই নতুন ব্যাংকের কর্মচারীরা অন্যরকম। এরা শিক্ষিত হলেও কৃষকদের মতো একই দৃষ্টিভঙ্গী ও নৈতিক মূল্যবোধ পোষণ করে” (উইলসন, ১৯৮৩:৭৬)।

ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপক এল-নাজ্জার (১৯৭৪:২৪৬-২৪৭) এর মতে, ব্যাংকটির কার্যক্রম ছিল তিন ধরনের: প্রথমত, পুঁজির চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে একটি দক্ষ সঞ্চারকের ভূমিকা পালন; দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক দক্ষতা, সঞ্চয় শিক্ষা ও ব্যাংকিং অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করা; এবং তৃতীয়ত, মজুতদারি ও পুঁজি গঠনের সমস্যা কমিয়ে আনা ও বিনিয়োগের জন্য অলস পুঁজির সমাবেশ ঘটাতে একটি গতিশীল চলক সৃষ্টি। 

উইলসন (১৯৮৩:৭৬) উল্লেখ করেন যে: “গৃহ নির্মাণ ও সংস্কার, হস্তশিল্পের জন্য সাধারণ মেশিনারি-- যেমন, কাপড় বোনার জন্য হস্তচালিত তাঁত বা সেলাই মেশিন কেনাসহ বহু ধরনের কাজে ব্যাংকটি ঋণ দিতো। খামারের গবাদি পশু কেনা এবং সেচ ব্যবস্থার মৌলিক উন্নতির জন্য ঋণ দেয়া হতো। বিশেষ করে, কৃষিভিত্তিক ওই এলাকার জন্য পানির সুব্যবস্থা করা ছিল জরুরি।”। 
এমজিআইএসবি দ্রুত অগ্রগতির পথে ধাবিত হয় এবং সাড়ে তিন বছরের মধ্যে আমানতকারী সংখ্যা ২৫১,০০০ ছাড়িয়ে যায়। প্রত্যাশার চেয়ে অনেক উচ্চ হারে সঞ্চয় বাড়তে থাকে। (১ নং ছক দেখুন। এতে, সামগ্রিকভাবে মিসরীয় ব্যাংকিং ব্যবস্থার (ইবিএস) মোট আমানতের সঙ্গে, একই সময়ের জন্য বর্তমান ও স্থির মূল্যে এমজিআইএসবি’র প্রবৃদ্ধি তুলনা করা হয়েছে। ছক ২, ৩ এবং ৪-এ আমানতকারীর সংখ্যা, সঞ্চয়ের গড় আকার, শাখা’র সংখ্যা এবং সঞ্চয়কারীদের ধরন--কারা ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করছে, তা দেখানো হয়েছে।

ছক ১ : ১৯৬৪-১৯৬৭ মেয়াদে ইবিএস এবং মিট-ঘামার ইসলামিক সেভিংস ব্যাংকের মোট আমানতের                  তুলনামূলক বিশ্লেষণ
বর্তমান মূল্যে
সাল     ইবিএসএর টিএলডি    সূচক     প্রবৃদ্ধি     এমজিআইএসবি’র    সূচক     প্রবৃদ্ধি
                  %       %          টিএলডি  %        %
    ১৯৬৪     ৩৭৮,০০০,০০০     ১০০     -     ৪০,৯৪৪     ১০০     -
    ১৯৬৫     ৩৯৬,০০০,০০০     ১০৫     ৫     ১৯১,২৩৫     ৪৬৭     ৩৬৭
    ১৯৬৬     ৪১৫,০০০,০০০     ১১০     ৫     ৮৭৯,৫৭০     ২১৪৮     ৩৬০
    ১৯৬৭     ৪৪৫,০০০,০০০     ১১৮     ৭     ১,৮২৮,৩৭৫     ৪৪৬৬     ১০৮
    গড়    ৬             ২৭৮
স্থির মূল্যে
    ১৯৬৪     ৩৬৪,৫১৩,০১০     ১০০     -     ৩৯,৪৮৩     ১০০     -
    ১৯৬৫     ৩৩২,২১৪,৭৬০     ৯১     -৯     ১৬০,৪৩২     ৪০৬     ৩০৬
    ১৯৬৬     ৩১৯,৭২২,৬৫০     ৮৮     -৪     ৬৭৭,৬৩৫     ১৭১৬     ৩২২
    ১৯৬৭     ৩৪০,৪৭৪,৩৬০     ৯৩     ৭     ১,৩৯৮,৯১০     ৩৫৪৩     ১০৬         গড়    - ২             ২৪৫

সূত্র : আইএমএফ ইন্টারন্যাশনাল ফিনান্সিয়াল স্ট্যাটিস্টিকক ও এল-নাজ্জার (১৯৭৪)।
শব্দ সংক্ষেপ : ইবিএস: ইজিপশিয়ান ব্যাংকিং সিস্টেম; এমজিআইএসবি : মিট ঘামার ইসলামিক সেভিং ব্যাংক

ছক ২ : মিট-ঘামার ইসলামিক সেভিংস ব্যাংকের আমানতকারী সংখ্যা এবং তাদের গড় আমানত
    বছর    আমানতকারী    প্রবৃদ্ধি      সঞ্চয়কারী প্রতি     প্রবৃদ্ধি
        সংখ্যা      %     গড় আমানত      %
১৯৬৪     ১৭,৫৬০     -     ২.৩৩     -
    ১৯৬৫     ৩০,৪০৪     ৭৩     ৬.২৯     ১৭০
    ১৯৬৬     ১৫১,৯৯৮     ৪০০     ৫.৭৯     -১
    ১৯৬৭     ২৫১,১৫২     ৬৫     ৭.২৮     ২৬
সূত্র : এল-নাজ্জার (১৯৭৪:২৭১)।

ছক ৩ : ১৯৬৩-১৯৬৭ সালের মধ্যে মিট-ঘামার ইসলামিক সেভিংস ব্যাংকের শাখা সংখ্যা
শাখার নাম    খোলার তারিখ        শাখার নাম    খোলার তারিখ

১. মিট ঘামার    ০৫-০৭-১৯৬৩     ৬. জেফতি    ০৯-০২-১৯৬৬
২. শারবিনি        ১৪-০৮-১৯৬৫     ৭. আল মাহাল্লাহ    ২৪-০৭-১৯৬৬
৩. আল মানসুরা    ১১-০৯-১৯৬৫     ৮. মিসর আল-জাদিদাহ    ২৩-০৭-১৯৬৬
৪. দাকেরুয়াস    ০৯-১০-১৯৬৫     ৯. বেলকা    ০১-১০-১৯৬৬
৫. কাসর আল আইনি    ১৪-১০-১৯৬৫

সূত্র : এল-নাজ্জার (্আইবিআইডি)

ছক ৪ : এমজিআইএসবি’তে বিভিন্ন সঞ্চয়কারী গ্রুপের মোট আমানতে সঞ্চয় ও বিনিয়োগের শতকরা অংশ

    সঞ্চয় আমানত    বিনিয়োগ আমানত    আমানতকারী

    ৫৩.৫     ৩৮.০    ছাত্র
    ১৪.০     ১২.০     শ্রমিক
    ২.৩     ১২.৮     পেনশনভোগী
    ০.২     ২২.০     সরকারি কর্মচারী
    ৫.১     ৬.৪     গৃহবধূ
    ১০.৯     ১৫.৯     কৃষক
    ২.০     ২.৪     ব্যবসায়ী
    ২.০     ২.০     অন্যান্য
সূত্র : এল-নাজ্জার (১৯৭৪:২৭২)।

প্রাপ্ত স্বল্প তথ্যের ভিত্তিতে দেখানো ছকগুলোর তুলনামূলক বিশ্লেষণ থেকে এটা স্পষ্ট যে, এই পরীক্ষাটি বেশ সফলতার প্রমাণ রাখে এবং সঞ্চয় সমাবেশ অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী, কৃষক ও গ্রামবাসীর সমর্থন লাভে সফল হয় এই ব্যাংক। তারা ব্যাংটিকে নিজেদের বলে মনে করতে শুরু করে বলে রিডি (১৯৬৭); এল-নাজ্জার (১৯৭৪), হারভে (১৯৮১); ট্রাউট (১৯৮৩) এবং উইলসন (১৯৮৩) আলোচনায় উল্লেখ করেছেন। এল-নাজ্জার (১৯৭৪:২৭২) মন্তব্য করেন: “ব্যাংকটি কার্যক্রম শুরু করার স্বল্প সময়ের মধ্যে এটা স্থানীয় সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ সেবা দিতে সক্ষম হয়। বিশেষ করে, মিট-ঘামার ও এর ৫৩টি গ্রামে ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠা ও এর উন্নয়ন এবং বেকার শ্রমিকদের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে এই ব্যাংক।”

বলা হয়, এই ব্যাংক এতটাই সফল হয়েছিলো যে এতদিনে তা গোটা মিসর তার আওতায় নিয়ে আসতে পারতো। কিন্তু, নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রাজনীতির কারণে ব্যাংকটি শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৯৬৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংকটি যখন বন্ধ হয়ে যায়, তখন এই ব্যাংক ও এর শাখাগুলোর কার্যক্রম ছিল এমন এলাকায় গ্রামীণ ঋণগ্রস্ততার সমস্যা ব্যাপকভাবে কমে এসেছিল। গুটিকতক স্থানীয় সুদখোর মহাজনের কাছে ঋণের জন্য ধর্ণা দিতে হতো না মানুষকে। তারা অনৈসলামিক ব্যাংকগুলোর কাছে যেতে পারতো না। কারণ তাদেরকে ‘ব্যাংক বহির্ভুত শ্রেণী’ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। আবার, এসব ব্যাংক যেহেতু ইসলামে হারাম (নিষিদ্ধ) সুদ (রিবা) নিয়ে কারবার করতো, গ্রামের ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষ সেখানে যেতে চাইতো না। 

এল নাজ্জার উল্লেখ করেন (১৯৭৮:২৩০-২৩২) যে : বিস্ময়কর না হলেও কথাটি স্ববিরোধী মনে হবে, ব্যাংকটির জন্য সমস্যা তৈরি করা না হলে এটি সফলতার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছিল। যখনই ব্যাংকটি স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়নের ক্ষেত্রে নিজের সফলতা স্পষ্ট করে তুলতে শুরু করলো, স্থানীয় সামাজিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শুরু হলো সংঘাত। তারা ভাবলো, তাদের কর্তৃত্বাধীন এলাকায় এই প্রতিষ্ঠানটি নাক গলাচ্ছে। তারা মনে করলো, ব্যাংকটি তাদের কাজগুলোই অহেতুক নকল করছে। ইতোমধ্যে ব্যাংকটি অধিকতর স্পষ্টভাবে ইসলামী বিশ্বাস ও চর্চার ভিত্তিতে একটি নতুন ব্যাংকিং ধারণা প্রবর্তন করে মুসলিম গ্রাহকদের মাঝে সাড়া ফেলতে সক্ষম হয় এবং সঞ্চয় ও সঞ্চয়কারীর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। অনেকে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে তাদের সঞ্চয় তুলে ইসলামী ব্যাংকে রাখতে শুরু করেন। তা প্রচলিত ব্যাংগুলোকে অপরিহার্যভাবে এই নতুন জনপ্রিয় ও দ্রুত বিকাশমান প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে দাড় করিয়ে দেয়। ক্ষুদ্র দৃষ্টিকোণ থেকে, ব্যাংকের কর্মকা- ও তৎপরতাকে বিদ্যমান বিভিন্ন সামাজিক কর্তৃপক্ষ, বাণিজ্যিক ব্যাংক ও কিছু কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করা হয়। তাই একে থামিয়ে দেয়া হয়। 

তারপরও, ঝুঁকিপূর্ণ এই উদ্যোগ আধুনিক ইসলামী ব্যাংকিং এর বীজ বপন করে এবং পরবর্তী উদ্যোগ গ্রহণের পথ দেখিয়ে দেয়। কিছুকালের মধ্যেই মিট-ঘামার ইসলামিক সেভিংস ব্যাংকের দেখানো পথে আরো উন্নত প্রক্রিয়ায় অনেক ইসলামী সামাজিক, উন্নয়ন ও বাণিজ্যিক ব্যাংক ব্যবসা শুরু করে। এগুলোর মধ্যে প্রথম, ১৯৭১ সালে মিসরে প্রতিষ্ঠিত হয় নাসের সোশ্যাল ব্যাংক। প্রথমে এটি ‘মুনাফা’ লাভের লক্ষ্য না নিয়ে ‘ব্যাংকিং আওতা বহির্ভুত’ স্বল্পআয়ের লোকজনকে সেবা দানের জন্য ‘সামাজিক ব্যাংক’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৭৫ সালে সউদী আরবের জেদ্দায় প্রতিষ্ঠিত হয় একটি আন্তঃসরকারী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানÑইসলামি ডেভলপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি)। সদস্য দেশগুলোর অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন জোরদার করা এই ব্যাংকের উদ্দেশ্য। একই বছর দুবাইয়ে (ইউএই) প্রতিষ্ঠিত হয় দুবাই ইসলামিক ব্যাংক। এগুলো ছিল প্রথম বড় আকারের ইসলামী বাণিজ্যিক ব্যাংক। এগুলোর সাফল্যের পথ ধরে বিভিন্ন দেশে বহু সংখ্যক ইসলামী ব্যাংক গড়ে ওঠে।
মিট-ঘামার সেভিংস ব্যাংক এর প্রায় একই সময়ে এরকম আরেকটি সফল পরীক্ষা ছিল, মালয়েশিয়ার তাবুং হাজি বা পিলগ্রিম ফান্ড করপোরেশন। ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠানটি কার্যক্রম শুরু করে। এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিল নিম্নরূপ:
*  মালয় মুসলমানরা যাতে হজ্ব সম্পাদন বা অন্যান্য লাভজনক উদ্দেশ্যে ধীরে ধীরে অর্থ সঞ্চয় করতে পারেন তার ব্যবস্থা করা।
*    সঞ্চয়ের মাধ্যমে ইসলাম অনুমোদিত বিনিয়োগ কর্মকা-ে মালয় মুসলমানদের সক্রিয় ও কার্যকর অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করা।
*    হজের সময় বিভিন্ন সুবিধা ও সেবা দানের মাধ্যমে হাজিদের কল্যাণ ও তাদের স্বার্থ রক্ষা ও নিশ্চিত করা।
এসব উদ্দেশ্য সামনে রেখে সেই সময় থেকে সাফল্যের সঙ্গে পরিচালিত হয়ে আসছে তাবুং হাজি। এটা চমৎকারভাবে হজের আগে ও পরে হাজযাত্রীদের প্রয়োজনীয় সব রকম সেবা মানসম্পন্নভাবে দিয়ে আসছে। ১৯৫৯ সালে রয়্যাল প্রফেসর উংকু আজিজ ‘সম্ভাব্য হজযাত্রীদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা’ বিষয়ে একটি কার্যপত্রে এই ধারণা প্রথম তুলে ধরেন (তাবুং হাজি ওয়েবসাইট)। ১৯৬৩ সালে মাত্র ১,২৮১ জন সদস্যের কাছ থেকে ৪৬,৬০০ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত আমানত নিয়ে কার্যক্রম শুরু করা আধা-সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটির সদস্য সংখ্যা (হিসাবধারী) এখন ৪ মিলিয়নের ওপরে এবং ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ওপরে এর সঞ্চয়। মালয়েশিয়ায় মুসলিম জনগোষ্ঠীর মোট হিসাব সংখ্যা যেখানে ১২ মিলিয়ন, সেখানে উপরোক্ত সংখ্যা দিয়ে বোঝা যায় প্রতিষ্ঠানটি কতটা জনপ্রিয় (রহমান, ২০০৪)।

সুদ-ভিত্তিক ব্যাংকগুলোর বিকল্প আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে তাবুং হাজি। এটি মালয়েশিয়ান মুসলমানদের হালাল উপায়ে বিনিয়োগের সুযোগ করে দিচ্ছে। যে কোন মালয়েশিয়ান প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলমান ১০ রিঙ্গিত এবং শিশু হলে ২ রিঙ্গিত কিস্তি দিয়ে এখানে হিসাব খুলতে পারে। এর শাখা রয়েছে ১১১টি। এছাড়াও পোস্ট অফিসের মাধ্যমে সেবা প্রদান এবং বেতন থেকে কিস্তি কেটে নেয়ার বিষয়টি আছে এখানে। কেউ সঞ্চয় তুলে নিতে চাইলে তাও, যে কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মতো সহজ উপায়ে তা করা যায়। তাবুং হাজি’র হিসাবধারীদের জন্য বাড়তি সুবিধা হলো, হজের সময় একটি বিশেষ উত্তোলন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সউদী আরবে বসেই তারা নিজ নিজ হিসাব থেকে অর্থ তুলতে পারেন। সংগৃহীত অর্থ, শরিয়াহ নির্দেশিত পথে এবং প্রবল সম্ভাবনাময় সুনির্দিষ্ট প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগ করা হয়। বর্তমানে এর বিনিয়োগের মোট পরিমাণ ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মতো। এতে রয়েছে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ। ইকুইটি ইনভেস্টমেন্ট, ইউনিট ট্রাস্ট ইনভেস্টমেন্ট, সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগ, আবাসন খাতে বিনিয়োগ ছাড়াও ১২টি সাবসিডিয়ারি কোম্পানিতে প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগ রয়েছে। এসব সাবসিডিয়ারি কোম্পানি কৃষি, বৃক্ষরোপন বা রিয়েল এস্টেট ব্যবসা থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসায় নিয়োজিত। ১৯৯৫ সাল থেকে তাবুং হাজিকে তার কার্যক্রমের আওতা বাড়ানোর অনুমতি দেয়া হয়। বর্তমানে মালয়েশিয়ার বাইরেও এর ব্যবসায়িক কার্যক্রম বিস্তৃত হয়েছে (আইবিআইডি)। জেনারেল কাউন্সিল অফ ইসলামিক ব্যাংক এন্ড ফিনান্সিয়াল ইন্সটিটিউটস (জিসিআইবিএফআই, ২০০১) এর মতে ইরান, পাকিস্তান ও সুদানের ব্যাংকিং ব্যবস্থা ইসলামীকরণ করা ছাড়াও সারা বিশ্বে ২৭০টির বেশি ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এগুলোর মোট সম্পদের পরিমাণ ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ওপরে, ২০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ওপরে রয়েছে আমানত এবং ১৬০ বিলিয়ম মার্কিন ডলারের ওপরে রয়েছে বিনিয়োগ। ১৯৭০’র দশকের শেষ এবং ১৯৮০’র দশকের গোড়ার দিকে মিসর, কুয়েত, জর্ডান, বাহরাইন, কাতার, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ, সেনেগাল, তিউনিস, তুরস্ক, আলজেরিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশে এসব বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু। সুদ-ভিত্তিক ব্যাংকগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা এবং অনৈসলামিক পরিবেশে কাজ করেও যাত্রা শুরুর প্রথম বছর থেকে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান উল্লেযোগ্য পরিমাণ সঞ্চয় সংগ্রহ, জাতীয় বাজারের একটি বড় অংশ দখল এবং বড় আকারের লাভ করতে থাকে। বর্তমানে সুইজারল্যান্ড, ডেনমার্ক, লুক্সেমবার্গ, ইংল্যান্ডসহ পশ্চিমা অনেক দেশে ইসলামী ব্যাংক ও ইসলামী বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। শুধু তাই নয় সিটিব্যাংক, এইচএসবিসিসহ অন্যান্য বড় বড় অ-ইসলামী ব্যাংক, এই দ্রুত বিকাশমান খাতে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে ‘ইসলামিক ব্যাংকিং শাখা’ চালু করেছে। 

বিশ্বের অনেক স্থানে আরো অনেক অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেমন, তাকাফুল কোম্পানি নামে বীমা কোম্পানি এবং অন্যান্য বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো, শোষনধর্মী পুঁজিবাদী ব্যবস্থার একটি বিকল্প ও সুদবিহীন ব্যাংকিং এর ধারণা তুলে ধরে, রিবা’র কারণে সুদভিত্তিক ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেনে অনিচ্ছুক ধর্মভীরু মুসলমানদের কাছে পড়ে থাকা অলস সম্পদগুলো একত্রিত করা। এ ব্যাপারে তারবুশ উল্লেখ করেছেন (১৯৮১:৬): “এই উদ্দেশ্য হাসিলে তাদের স্পষ্টত কোন সমস্যা ছিল না। বলা হয় যে, জনগণের জন্য খুলে দেয়ার প্রথম দিনেই কুয়েত ফিন্যান্স হাউস (কুয়েতের ইসলামী ব্যাংক) ৫০ মিলিয়ন কুয়েতি দিনার (১৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) আমানত লাভ করে। যা বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে এই ব্যাংকে স্থানান্তর করা হয়।” বর্তমান কয়েকটি ইসলামি ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, এর অনেকগুলোই এমন উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছে, যা তাদেরকে আরব অঞ্চলের শীর্ষ ১০০ ব্যাংকের তালিকায় স্থান দিয়েছে। ইসলামী ব্যাংকগুলো ক্রমেই আরো উন্নতি করছে (ছক-৫ দেখুন, এতে শীর্ষ ১০০ আরব ব্যাংকের তালিকায় থাকা বিভিন্ন দেশের কয়েকটি ইসলামী ব্যাংকের অবস্থান দেখানো হয়েছে)।

ছক ৫ : শীর্ষ ১০০ আরব ব্যাংকের মধ্যে কয়েকটি ইসলামী ব্যাংকের অবস্থান
বছর     কেএফএইচ     এফআইবিই     কিউআইবি     ডিআইবি     জেআইবি     এসবিবি     আরবিআইসি
১৯৮০     ৯৪        -            -     -         -     -    -
১৯৮১     ৬৮     -            -     -           -         -         -
১৯৮২     ৫১         ৭৭        -     -         -         -     -
১৯৮৩     ৪২     ৬৬           -     -         -         -         -
১৯৮৪     ৩৪     ৪৭            -    -         -         -         -
১৯৮৫     ৩৯     ৪৫            -     ৯৭         -         -         -
১৯৮৬     ৩৬     ৪৩            -     ৮৭         ৮৭         -         -
১৯৮৭     ২৮     ৪৮            -     ৯৩         ৮৫         -         -
-----------------------------------------------------------২০০০     ২৪     ৯০     ৯১     ৪৮     ৯৬     ৫৮     -
২০০১     ২১     ৯৫     ৮৬     ৪৮     ৯৭     ৫৪     -
----------------------------------------------------------
২০০৪     ২১     -     ৯০     ৩৮     -     ৫৮     ৬
সূত্র : দি ব্যাংকার, বিভিন্ন ইস্যু 

শব্দ সংক্ষেপ: কেএফএইচ : কুয়েত ফিনান্স হাউজ; এফআইবিই : ফয়সাল ইসলামিক ব্যাংক অব ইজিপ্ট; কিউআইবি : কাতার ইসলামিক ব্যাংক; ডিআইবি : দুবাই ইসলামিক ব্যাংক; জেআইবি : জর্ডান ইসলামিক ব্যাংক; এসবিবি : শামিল ব্যাংক অব বাহরাইন; আরবিআইসি : রাঝি ব্যাংকিং এন্ড ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন।

নিয়েনহাউস (১৯৮৮:৯০) উল্লেখ করেছেন: দেখা যায়, “তুলনামুলক স্বল্প সময়ের মধ্যে এসব ইসলামী ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সম্মানজনক আকারে পৌঁছে গেছে।” এগুলোর কয়েকটি যেমন, কেএফএইচ, এফআইবিই, জেআইবি এবং এসএসবি -সঞ্চয় সংগ্রহ ক্ষেত্রে বাজার শেয়ার এর প্রবৃদ্ধি কিছুটা ধীর হয়ে এলেও নিজ নিজ দেশের শীর্ষ সাত এর তালিকায় রয়েছে এসব ব্যাংক। এগুলোর তহবিলে বরাদ্দের পরিমাণও লক্ষ্যণীয়ভাবে বেড়েছে।

৬. উপসংহার
ব্যাংকিং ও ফিনান্স এর উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে ঐতিহাসিক সাক্ষ্য-প্রমাণে দেখা যায়, দ্বাদশ শতকে ইতালির অনেক আগে থেকেই বহু সভ্যতায় ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু ছিল। অথচ, বেশিরভাগ অর্থনীতিবিদ ইতালিকে ‘ব্যাংকিং এর জন্মস্থান’ বলে মনে করেন। এর অনেক আগে ইসলামী, রোমান, গ্রিক, মিসরীয়, এমনকি ব্যাবিলনিয় ও সুমেরিয় সভ্যতায় ব্যাংকিং কার্যক্রমের চর্চা ছিল। বস্তুত, অনেক ঐতিহাসিক প্রমাণে দেখা যায়, খৃস্টপূর্ব ৩৪ শতকে (অর্থাৎ, ৫,৪০০ বছর আগে) ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো অত্যন্ত আধুনিক ধরনের ব্যাংকিং ব্যবস্থা পরিচালনা করতো। তারা সঞ্চয়কারীদের সঞ্চয় সুরক্ষা এবং যাদের অর্থের প্রয়োজন হতো তাদের ঋণ দিতো-ব্যাংকের মতো কাজ করতো। হোমুদ (১৯৮৫:১৬-১৭) উল্লেখ করেন: একে অন্যভাবে বলা যায় “বিশ্বের বিভিন্নস্থানে লুপ্ত হয়ে যাওয়া অনেক প্রাচীন সভ্যতায় বিভিন্ন ধরন ও বেশে ব্যাংকিং প্রচলিত ছিল।”

ইউরোপে কিভাবে আধুনিক ব্যাংকিং এর বিকাশ ঘটে এবং পরে মুসলিম বিশ্বে স্থানান্তরিত হয়, তা আমরা দেখিয়েছি। সুদ-ভিত্তিক ব্যাংকে সঞ্চয় রাখতে মুসলমানদের অনীহার কারণে মুসলিম বিশ্বে সুদ-ভিত্তিক আধুনিক ব্যাংকগুলোর কার্যক্রমে যে ঘাটতি দেখা দেয়,  ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থা কিভাবে সেই ঘাটতি পূরণে এগিয়ে আসে, আমরা তাও দেখিয়েছি। সুদ হলো রিবা এবং ইসলামে রিবা অত্যন্ত কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

------------------------------------------------------------------------------------------------- 

No comments:

Post a Comment