ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিৎ সে সম্পর্কে আমরা কম-বেশী সবাই জানি। একজন আদর্শ শিক্ষকের যে গুণাবলীর কথা বলা হয়ে থাকে তা আজকাল আর তেমন চোখে পড়ে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স এ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগে পড়ার সময় মাস্টার্সে উঠে জানতে পারলাম জনাব লুৎফর রহমান সরকার, যিনি প্রাইম ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত, তিনি আমাদের ক্লাস নিবেন। ক্লাস ক্যাপ্টেন হিসেবে আমার উপর বাড়তি দায়িত্ব ছিল শিক্ষকদের কলা ভবনের সামনে থেকে নির্ধারিত ক্লাস পর্যন্ত নিয়ে আাসা।
প্রথম দেখাতেই তাঁর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ব্যবহার আর চেহারায় অভিভূত হই। দিন যায় ওনার ক্লাসগুলি মন্ত্রমুগ্ধের মতো উপভোগ করি, অদ্ভূত শিহরণ বয়ে যায় ক্লাসের ছেলেমেয়েদের মধ্যে। কত সাবলীল আর সহজ ভঙ্গিতে ব্যাংকিং ক্লাস নিচ্ছেন।
পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে তাঁর সুদীর্ঘ ব্যাংকিং জীবনের সঞ্চিত বাস্তব অভিজ্ঞতার আলো বিলাচ্ছেন ছাত্রদের মাঝে। একজন মানুষ কতটা সমাজ সচেতন হলে তার ছাত্রদের নিয়ে গভীরভাবে ভাবেন, তা তার পড়ানোর মধ্যেই পেয়েছি।
এর কিছুদিনের মধ্যে জানতে পারলাম তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর মনোনিত হয়েছেন। কিন্তু তাই বলে তার মধ্যে কোনো দাম্ভিকতা ছিলনা। আমি একজন নিতান্ত সাধারণ ছাত্র হিসেবেও বাংলাদেশ ব্যাংকে তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী হলে তিনি সানন্দে সময় দিয়েছেন। মূল্যবান পরামর্শ/উপদেশ দিয়েছেন।
ইতোপূর্বে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকাকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের দরিদ্র ছাত্রদের আর্থিকভাবে সাবলম্বী করে গড়ে তোলার প্রয়াসে তার উদ্ভাবিত ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্মসংস্থান প্রকল্প’ (বিকল্প) ছিল সকল মহলের কাছে প্রশংসিত। মেধাবী ছাত্রদের ব্যাংকের চাকরীর প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য সরাসরি নিয়োগ, বিশেষ পদ ও বেতনভাতা প্রদানের নীতিমালাও হাতে নিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণরের নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে তিনি মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড এ প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বে নিয়োজিত হন। সৌভাগ্যক্রমে একই ব্যাংকে কর্মরত থাকার সুবাদে আমি স্যারের ব্যক্তিগত সচিব (পি.এস) হিসাবে দীর্ঘদিন তার পাশে থেকে একজন সৎ, নিষ্ঠাবান ও কর্তব্যপরায়ন মানুষকে দেখার সুবর্ণ সুযোগ পাই।
তাঁর চিন্তা চেতনায় সবসময় আবর্তিত হতো কিভাবে স্বল্প আয়ের মানুষদের ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা যায়। ব্যাংকের নতুন নতুন প্রোডাক্ট/স্কিম প্রবর্তণ ও বাস্তবায়নে সবসময় গবেষণা করতেন।
তার উদ্ভাবিত নানা প্রকল্পের সুফল এখন প্রায় সব ব্যাংকগুলিই কমবেশি ভোগ করছে। তাঁর কথাবার্তার ভঙ্গিমা যেমন সহজ ছিল, তেমন ব্যাংকিং সহজীকরণের প্রবণতাও ছিল চোখে পড়ার মতো। সততার ব্যাপারে তিনি ছিলেন অবিচল, নীতি আদর্শের সাথে কখনও আপোষ করেননি।
কোন ভয়-ভীতি, চাপ বা প্রলোভনই নীতি ও আদর্শ থেকে বিচ্যুতি ঘটাতে পারেনি। স্রোতের প্রতিকূলে কিভাবে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে হয় এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে ব্যাংকিং কার্যক্রম কিভাবে পরিচালনা করা যায়, সেটি তিনি তাঁর কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আমাদের শিখিয়ে গেছেন।
বাংলা সাহিত্যেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য । তাঁর প্রবন্ধ, ছড়া, উপন্যাস ও অন্যান্য লেখার মধ্যে পাওয়া যায় সমাজ পরিবর্তনের অঙ্গীকার । নিজে যেমন শুদ্ধ সাবলীল জীবনাচার করেছেন তাঁর লেখনীতেও দেখা যায় তারই বহিঃপ্রকাশ।
তাঁর লেখা রম্য রচনা ”জীবন যেখানে যেমন” অত্যন্ত পাঠক প্রিয় একটি বই। বইটি পড়লে অবাক লাগে এই ভেবে যে, তাঁর মতো একজন রাশভারী মানুষের ভেতরে এতটা রসবোধ কাজ করে।
দরিদ্র মানুষের কল্যাণে বগুড়া জেলার নিজগ্রাম ফুলকোট-এ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নানা সামজিক সংগঠন ও শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান ।
গত ১ ফেব্র“য়ারী ২০১৩ জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে গিয়েছিলাম স্যারের বাসায়। আমাদের দেখে তিনি ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। অসুস্থ শরীরেও তিনি আমাদের সাদরে গ্রহন করে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করলেন।
সেদিনও ব্যাংকিংয়ের নানা খুটিনাটি বিষয় নিয়ে আমাদের সঙ্গে অনেক আলাপ করলেন। এক পর্যায়ে প্রশ্ন করলাম- স্যার, আপনি ব্যাংক ও ব্যাংকিং নিয়ে এখনো এত ভাবেন? তাঁর সরল উত্তর- হ্যাঁ, ভাবতে হয়, মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত ব্যাংকের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে ভাববো, তোমরাও যদি কোনো সমস্যায় পড় চলে আসবে, আলাপ আলোচনা করে নিশ্চয় একটা সমাধান খুঁজে বের করতে পারব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে যখন তাঁর নামাজে জানাজা পড়তে গেলাম তখন অনেক বড় বড় ব্যাংকারদের শরীক হতে দেখেছিলাম, ছিলেন তাঁর প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং ডিপার্টমেন্টের অনেক শিক্ষক- ছাত্র।
এত মানুষের ভিড়েও আমার বুঝে নিতে কষ্ট হয়নি তাদের সবার চোখের আকুতি- কি যেন হারালাম। অশ্র“ সজল চোখে সবার মধ্যেই ছিল কেমন যেন এক হতাশা। সেই ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি ভাবছিলাম, কেন এত তাড়াতাড়ি স্যার চলে গেলেন না ফেরার দেশে, আর তো কোনোদিন তাকে ফিরে পাব না। সেদিন বিকেলে বার বার চোখ মুছতে মুছতে শুধু এ কথাটাই মনে হচ্ছিল- আমরা শুধু একজন লিজেন্ড ব্যাংকারকেই হারালাম না, হারালাম একজন আদর্শ শিক্ষাগুরুকেও।
-----------------
মোঃ মুকিতুল কবীর,
ব্যাংকার.
মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স এ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগে পড়ার সময় মাস্টার্সে উঠে জানতে পারলাম জনাব লুৎফর রহমান সরকার, যিনি প্রাইম ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত, তিনি আমাদের ক্লাস নিবেন। ক্লাস ক্যাপ্টেন হিসেবে আমার উপর বাড়তি দায়িত্ব ছিল শিক্ষকদের কলা ভবনের সামনে থেকে নির্ধারিত ক্লাস পর্যন্ত নিয়ে আাসা।
প্রথম দেখাতেই তাঁর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ব্যবহার আর চেহারায় অভিভূত হই। দিন যায় ওনার ক্লাসগুলি মন্ত্রমুগ্ধের মতো উপভোগ করি, অদ্ভূত শিহরণ বয়ে যায় ক্লাসের ছেলেমেয়েদের মধ্যে। কত সাবলীল আর সহজ ভঙ্গিতে ব্যাংকিং ক্লাস নিচ্ছেন।
পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে তাঁর সুদীর্ঘ ব্যাংকিং জীবনের সঞ্চিত বাস্তব অভিজ্ঞতার আলো বিলাচ্ছেন ছাত্রদের মাঝে। একজন মানুষ কতটা সমাজ সচেতন হলে তার ছাত্রদের নিয়ে গভীরভাবে ভাবেন, তা তার পড়ানোর মধ্যেই পেয়েছি।
এর কিছুদিনের মধ্যে জানতে পারলাম তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর মনোনিত হয়েছেন। কিন্তু তাই বলে তার মধ্যে কোনো দাম্ভিকতা ছিলনা। আমি একজন নিতান্ত সাধারণ ছাত্র হিসেবেও বাংলাদেশ ব্যাংকে তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী হলে তিনি সানন্দে সময় দিয়েছেন। মূল্যবান পরামর্শ/উপদেশ দিয়েছেন।
ইতোপূর্বে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকাকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের দরিদ্র ছাত্রদের আর্থিকভাবে সাবলম্বী করে গড়ে তোলার প্রয়াসে তার উদ্ভাবিত ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্মসংস্থান প্রকল্প’ (বিকল্প) ছিল সকল মহলের কাছে প্রশংসিত। মেধাবী ছাত্রদের ব্যাংকের চাকরীর প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য সরাসরি নিয়োগ, বিশেষ পদ ও বেতনভাতা প্রদানের নীতিমালাও হাতে নিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণরের নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে তিনি মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড এ প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বে নিয়োজিত হন। সৌভাগ্যক্রমে একই ব্যাংকে কর্মরত থাকার সুবাদে আমি স্যারের ব্যক্তিগত সচিব (পি.এস) হিসাবে দীর্ঘদিন তার পাশে থেকে একজন সৎ, নিষ্ঠাবান ও কর্তব্যপরায়ন মানুষকে দেখার সুবর্ণ সুযোগ পাই।
তাঁর চিন্তা চেতনায় সবসময় আবর্তিত হতো কিভাবে স্বল্প আয়ের মানুষদের ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা যায়। ব্যাংকের নতুন নতুন প্রোডাক্ট/স্কিম প্রবর্তণ ও বাস্তবায়নে সবসময় গবেষণা করতেন।
তার উদ্ভাবিত নানা প্রকল্পের সুফল এখন প্রায় সব ব্যাংকগুলিই কমবেশি ভোগ করছে। তাঁর কথাবার্তার ভঙ্গিমা যেমন সহজ ছিল, তেমন ব্যাংকিং সহজীকরণের প্রবণতাও ছিল চোখে পড়ার মতো। সততার ব্যাপারে তিনি ছিলেন অবিচল, নীতি আদর্শের সাথে কখনও আপোষ করেননি।
কোন ভয়-ভীতি, চাপ বা প্রলোভনই নীতি ও আদর্শ থেকে বিচ্যুতি ঘটাতে পারেনি। স্রোতের প্রতিকূলে কিভাবে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে হয় এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে ব্যাংকিং কার্যক্রম কিভাবে পরিচালনা করা যায়, সেটি তিনি তাঁর কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আমাদের শিখিয়ে গেছেন।
বাংলা সাহিত্যেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য । তাঁর প্রবন্ধ, ছড়া, উপন্যাস ও অন্যান্য লেখার মধ্যে পাওয়া যায় সমাজ পরিবর্তনের অঙ্গীকার । নিজে যেমন শুদ্ধ সাবলীল জীবনাচার করেছেন তাঁর লেখনীতেও দেখা যায় তারই বহিঃপ্রকাশ।
তাঁর লেখা রম্য রচনা ”জীবন যেখানে যেমন” অত্যন্ত পাঠক প্রিয় একটি বই। বইটি পড়লে অবাক লাগে এই ভেবে যে, তাঁর মতো একজন রাশভারী মানুষের ভেতরে এতটা রসবোধ কাজ করে।
দরিদ্র মানুষের কল্যাণে বগুড়া জেলার নিজগ্রাম ফুলকোট-এ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নানা সামজিক সংগঠন ও শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান ।
গত ১ ফেব্র“য়ারী ২০১৩ জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে গিয়েছিলাম স্যারের বাসায়। আমাদের দেখে তিনি ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। অসুস্থ শরীরেও তিনি আমাদের সাদরে গ্রহন করে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করলেন।
সেদিনও ব্যাংকিংয়ের নানা খুটিনাটি বিষয় নিয়ে আমাদের সঙ্গে অনেক আলাপ করলেন। এক পর্যায়ে প্রশ্ন করলাম- স্যার, আপনি ব্যাংক ও ব্যাংকিং নিয়ে এখনো এত ভাবেন? তাঁর সরল উত্তর- হ্যাঁ, ভাবতে হয়, মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত ব্যাংকের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে ভাববো, তোমরাও যদি কোনো সমস্যায় পড় চলে আসবে, আলাপ আলোচনা করে নিশ্চয় একটা সমাধান খুঁজে বের করতে পারব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে যখন তাঁর নামাজে জানাজা পড়তে গেলাম তখন অনেক বড় বড় ব্যাংকারদের শরীক হতে দেখেছিলাম, ছিলেন তাঁর প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং ডিপার্টমেন্টের অনেক শিক্ষক- ছাত্র।
এত মানুষের ভিড়েও আমার বুঝে নিতে কষ্ট হয়নি তাদের সবার চোখের আকুতি- কি যেন হারালাম। অশ্র“ সজল চোখে সবার মধ্যেই ছিল কেমন যেন এক হতাশা। সেই ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি ভাবছিলাম, কেন এত তাড়াতাড়ি স্যার চলে গেলেন না ফেরার দেশে, আর তো কোনোদিন তাকে ফিরে পাব না। সেদিন বিকেলে বার বার চোখ মুছতে মুছতে শুধু এ কথাটাই মনে হচ্ছিল- আমরা শুধু একজন লিজেন্ড ব্যাংকারকেই হারালাম না, হারালাম একজন আদর্শ শিক্ষাগুরুকেও।
-----------------
মোঃ মুকিতুল কবীর,
ব্যাংকার.
মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড
স্যার লুৎফর রহমানের বাড়ী কোথায়??? plzz answer
ReplyDelete