Monday 4 March 2013

৩. সংসার সাজাতে স্বামী ও স্ত্রীর ভূমিকা- ইসলামের আলোকে


বইয়ের নামঃ ফী ত্বলাবুল জান্নাত (জান্নাতের খোঁজে)
লেখক ঃ খন্দকার নাজনীন সুলতানা
৩. সংসার সাজাতে স্বামী ও স্ত্রীর ভূমিকা- ইসলামের আলোকে

বিয়ের মাধ্যমেই একটি ছেলে ও মেয়ের সাংসারিক বন্ধনের সূত্রপাত। বিয়ের ক্ষেত্রে ছেলেরা মেয়েদের হরেক রকম গুনের খোঁজ করে। ভাবে রুপে ক্লিওপেট্রা, গুনে লক্ষ্মী, বিদ্যার স্বরস্বতী- এমন কনে যদি পাই, তবেই বিয়ে করি। তাকি আর সম্ভব?

তাই বিবাহের পূর্বে কণে নির্বাচনের সময় পাত্রকে ধরে নিতে হবে যে, কণের সর্বগুণ এক সাথে পাওয়া সম্ভব নয়। পৃথিবীর এক এক মেয়ে এক এক গুনে গুনান্বিতা, পাত্রীর কোন গুনটিকে পাত্র অগ্রাধিকার দেবেন, সে দ্বায়িত্ব তার নিজের।


পাত্রী নির্বাচনের বিষয়ে হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) হতে বর্নিত একটি হাদীসে আমরা পাই, নবী করীম (সাঃ) বলেছেনÑ “মেয়েদেরকে সাধারনত চারটি বিষয় দেখে বিয়ে করা হয়। তার সম্পদ দেখে, বংশ মর্যাদা দেখে, রুপ-সৌন্দর্য দেখে এবং তার দ্বীনদারী দেখে। তবে তোমরা দ্বীনদারী মেয়ে লাভ করার চেষ্টা কর, তোমাদের কল্যান হবে।”  (বুখারী, মুসলিম)

ধরুন, স্বামী অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং বিচক্ষন, তাই দেখে শুনে দ্বীনদারী মেয়েকেই স্ত্রী হিসাবে গ্রহন করলেন। এখন আপনার সংসারে নববধুর ভূমিকা এবং দায়-দায়ীত্ব কি হবে তা স্বামীর উপরেই নির্ভর করে।

নববধু মেয়েটি তার মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সমস্ত পরিচিত জনদের ছেড়ে, সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে, নতুন মানুষদের মাঝে স্বামীর সংসার করতে আসে। তার কাছ থেকে সাংসারিক কাজকর্মে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ মা কিংবা খালার মত পারদর্শিতাতো আর আশা করা যায় না। নববধুকে নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেবার সুযোগ দিতে হবে। সাংসারিক সব কাজ শেখার প্রয়োজনীয় সময় দিতে হবে।


সূরা বাক্বারার ২২৮ নম্বর আয়াতে আছে-
"পুরুষদের যেমন স্ত্রীদের উপর অধিকার রয়েছে, তেমনিভাবে স্ত্রীদেরও অধিকার রয়েচে পুরুষদের উপর নিয়ম অনুযায়ী। আর নারীদের উপর পুরুষদের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে।"

আল্লাহ হচ্ছেন মহাপরাক্রমশালী, বিজ্ঞ। তাই নারীদের উপর পুরুষদের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করেছেন। তাই বলে নারীরা একেবারেই অবহেলার পাত্র হবে তা তো নয়। তার পছন্দ-অপছন্দ, ভালো-মন্দ, চাওয়া-পাওয়ার মূল্যায়নতো করতেই হবে। নারী, সেও তো একজন মানুষ, মানবিক অধিকার গুলো অবশ্যই তার কাম্য। আর বিজ্ঞ স্বামী হিসাবে আপনার ভূমিকা ও দায়-দায়ীত্ব কি হবে, তা স্বামীকে অবশ্যই বুঝতে হবে।

সংসারকে সুন্দর ও সুষমামন্ডিত করার সমস্ত দায়-দায়ীত্ব যদি নববধুর উপর চাপিয়ে দেয়া হয়, তবে তা কি ইনসাফ হয়? বিজ্ঞ স্বামী, সকালে ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে বা গোসল করে, নাস্তা শেষে চলে গেলেন অফিসে বা আপন কর্মক্ষেত্রে। ফিরে এলেন রাত বারোটা, একটায়। নববধু সারাদিন ঘরে একা একা কি করবেন? ধার্মীক নববধু হয়তো নতুন সংসারের টুক টাক কাজ কর্ম সেরে বসে বসে নামাজ পড়লেন। আর দোয়া-দুরুদ পড়ে পড়ে কান্নাকাটি করলেন। এভাবে কয়দিন চলবে? নিঃসঙ্গ, একাকী থাকতে থাকতে একদিন নববধু হয়ে যাবেন মানষিকভাবে ভারসাম্যহীন, পাগোল, তখন স্বামীর সংসারকে সুন্দর আর সুষমামন্ডিত করবে কে?

বিজ্ঞ স্বামী স্ত্রীর মন খারাপ আর কান্নাকাটি দেখে ভাবলেন, থাক কিছুদিন অফিসে যাব না। এই ভেবে দুই-তিন মাস একাধারে বাসায় বসে রইলেন। এতে আপনার চাকরীটা যাই যাই করবে, বা চলেই যাবে। আর ব্যবসায়ী হলে ব্যবসার জ্বলবে লাল বাতি।

স্বামীকে হতে হবে দৈহিক ও মানষিকভাবে সুস্থ্য এবং স্বাভাবিক। কাজও করবেন, স্ত্রীকেও সময় দিবেন। ছুটির দিনগুলোতে ঘরে বিশেষ কোন কাজ না থাকলে বেড়িয়ে পরতে পারেন মনোরম সুন্দর আকর্ষনীয় কোন স্থানে কিংবা যেতে পারেন কোন বন্ধু-বান্ধবের বাসায়। এতে মনও প্রফুল্ল হবে, সামাজিকতাও রক্ষা পাবে। অজুহাত দেখাবেন না যে, সময় নেই, ব্যস্ত, কারণ যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে। যে পারে সবই পারে, আর যে পারে না সে কিছুই পারে না।

সূরা আন নিসার প্রথম আয়াতে আছে-
“হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর। যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার সঙ্গীনীকে সৃষ্টি করেছেন। আর বিস্তার করেছেন তাদের দু’জন থেকে অগনিত পুরুষ ও নারী।”

আল্লাহ প্রথমে হযরত আদম (আঃ) কে সৃষ্টি করলেন, তারপর সৃষ্টি করেন বিবি হাওয়া (রাঃ) কে। তাই নবী করীম (সাঃ) এরশাদ করেনÑ“নারীকে বাঁকা হাড় হতে তৈরী করা হয়েছে যদি সোজা কর ভেঙ্গে যাবে। এজন্য ভালোবাসার আচরণ কর, তাহলে জীবন নির্বাহ হবে।”   (ইবনে হিরান)

সূরা রুম-এর ২১ নম্বর আয়াতে আছে-

“আল্লাহ তা’আলার একটি বড় নিদর্শন হল, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন। যেন তোমরা তাদের কাছে গিয়ে আরাম বোধ কর। অধিকন্তু, তিনি উভয়ের মাঝে সৃষ্টি করেছেন ভালবাসা ও সহমর্মিতা।”

স্ত্রী এবং স্বামী উভয়েরই কখনও কারো মনে কষ্ট দেয়া উচিৎ নয়। এ সম্পর্কে একটি হাদীস উল্লেখ করা যায়।সাহাবী হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) এরশাদ করেনÑ “যখন কোন মহিলা তার স্বামীকে কষ্ট দেয়, তখন আল্লাহ তা’লার পক্ষ থেকে স্বামীদের স্ত্রীরুপে নির্ধারিত বেহেশতের ডাগরচোখা রমনীগণ দুনিয়ার স্ত্রীদেরকে লক্ষ করে বলতে থাকে, তুমি একে কষ্ট দিও না, কারণ এতো তোমাদের কাছে কয়েকদিনের মেহমান মাত্র। এবং খুব শীঘ্রই সে তোমাদের ছেড়ে আমাদের কাছে চলে আসবে।”

নবী করীম (সাঃ) ছিলেন পৃথিবীর সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ স্বামী। তিনি তাঁর স্ত্রীদের সাথে অত্যন্ত ভালো ব্যবহার করতেন। এ সম্পর্কে হুযুর করীম (সাঃ) বলেছেনÑ“তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক ভালো মানুষ তারাই যারা তাদের স্ত্রীদের সাথে ভাল ব্যবহার করে। আর আমি তোমাদের মধ্যে আমার স্ত্রীদের সাথে সবচেয়ে ভালো আচরণকারী।”


সূরা বাক্বারার ১৮৭ নম্বর আয়াতে আছে-“তারা তোমাদের জন্য পোশাক এবং তোমরাও তাদের জন্য পোশাক।” অর্থাৎ স্ত্রীরা স্বামীদের ভুষণ এবং স্বামীরাও স্ত্রীদের ভূষণ। একে অন্যের পরিপূরক।
 
‘মিলে মিশে করি কাজ, হারি-জিতি নাহি লাজ’। সংসারের যে কোন কর্মকান্ডে স্বামী-স্ত্রী দু’জনকেই দু’জনার মতামতের মূল্য দিতে হবে। নারীদের উপর পুরুষদের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে, তাই শ্রেষ্ঠ স্বামী যদি জোর পূর্বক তার মতামত বা সিদ্ধান্তকে অসহায় স্ত্রীর উপর চাপিয়ে দেন, তবে স্ত্রী বেচারী তো ধীরে ধীরে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বে, তাই নয় কি? একজন অসুস্থ স্ত্রী কী তখন গড়তে পারবেন, মনের মতো সুন্দর ভালোবাসার সংসার ? তাই স্ত্রীকে সুস্থ রাখার দায়ীত্ব বিজ্ঞ স্বামীরই।

হুযুরে আকরাম (সাঃ) এরশাদ করেন-“স্ত্রীর উপর হঠাৎ অসন্তুষ্ট হয়ো না, যদি তার একটি স্বভাব অপছন্দ হয়, তবে অন্যটি পছন্দনীয় হবে।” (মুসলিম)

রাসূলে করীম (সাঃ) এরশাদ করেন-“নেককার স্ত্রী-যে স্ত্রী ঈমানের সাহায্যকারী, সে একজন মুসলমানের জন্য পরম সম্পদ।”

স্ত্রী যদি নেককার হয়, তবে সে অবশ্যই বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন হবে। সেক্ষেত্রে স্ত্রীর কোন আচরণ, ব্যবহার বা কাজ যদি স্বামীর পছন্দ না হয়, তবে বিজ্ঞ স্বামী রাগারাগি না করে স্ত্রীকে বুঝিয়ে বললেই পারেন, ভালো ব্যবহার আর আদরেতো বনের পশুও পোষ মেনে যায়। আর স্ত্রীতো রক্ত মাংসের মানুষ।

রাসূলে আকরাম (সাঃ) এরশাদ করেনÑ "কোন মুমিন ব্যক্তির জন্য পরহেজগারীর পর নেককার স্ত্রী অপেক্ষা উত্তম কোন সম্পদ নেই।
নেক স্ত্রীর লক্ষন গুলো হলো Ñ
(১) যখন তাকে কোন নির্দেশ দেয়া হয়, তা সে পালন করে।
(২) স্বামী যখন তার মুখের দিকে তাকায়, তখন সে স্বামীকে আনন্দ দান করে।
(৩) যদি তাকে কোন শপথ দেয়া হয়, তবে সে তা পূরণ করে।
(৪) স্বামী যদি কখনও বিদেশে চলে যায়, তবে স্বামীর অনুপস্থিতে সে নিজের সতীত্ব ও স্বামীর ধন-সম্পদ রক্ষা করে।"  (ইবনে মাজা)

সারল্য নারীর সৌন্দর্য, নারীরা হবে- সহজ, সরল এটাই স্বাভাবিক। অযথা এবং অকারণে স্ত্রীদের সন্দেহ করা উচিৎ নয়। সঠিক জিনিস না জেনে শুধু মাত্র সন্দেহ বা অনুমানের উপর স্ত্রীর সাথে খারাপ আচরণ করা অমানবিক।

এ সম্পর্কে সূরা নূর-এর ২৩ নম্বর আয়াতে আছে-“যারা সতী-সাধধী, সরলমনা ও বিশ্বাসী নারীদের প্রতি অপবাদ আরোপ করে, তারা দুনিয়া ও আখেরাতে অভিশপ্ত। এবং তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি।”

অনেক স্বামী আছে যারা স্ত্রীকে মেরে ধরে নিজের কতৃত্ব জাহির করতে চায়। অবলা অসহায় স্ত্রীকে মেরে এরা অনুুতপ্ততো হয়ইনা বরংচ ভাবে, এটা তাদের ক্ষমতা ও বাহাদুরীর বহিঃপ্রকাশ এবং স্ত্রীর উপর স্বামীত্ব ফলানো হচ্ছে। অকারণে বা সামান্য কারণে স্ত্রীর গায়ে হাত তোলা জঘন্য অপরাধ। স্বামীর অত্যন্ত নীচু স্বভাবের পরিচয়।
কথায় আছেÑ‘দরবারে জিততে না পারলে ঘরে এসে বৌ কিলায়’। স্ত্রীর সাথে এমনটি করবেন না।

হযরত আয়শা (রাঃ) বলেনÑ “প্রিয় নবী (সাঃ) সারা জীবনে কখনই কোন স্ত্রীর গায়ে হাত তোলেননি। এবং যখনই তিনি ঘরে প্রবেশ করতেন, তাঁর মুখশ্রী থাকতো ইষৎ হাস্যভায় স্নিগ্ধময়।”

সূরা নিসার ৩৪ নং আয়াতে আছে-
“পুরুষরা নারীদের উপর কৃতৃত্বশীল এজন্য যে, আল্লাহ একের উপর অন্যের বৈশিষ্ট্য দান করেছেন। এবং এজন্য যে, তারা তাদের অর্থ ব্যয় করে। সেমতে নেককার স্ত্রীলোকগণ হয় অনুগত এবং আল্লাহ যা হেফাযতযোগ্য করে দিয়েছেন লোকচক্ষুর অন্তরালেও তার হেফাযত করে।”

একজন সৎ ও আদর্শ স্ত্রীকে অবশ্যই তার স্বামীর সব কথা মেনে চলতে হবে। অবশ্য তা যদি ইসলাম বিরোধী না হয়। কারণ আল্লাহ এবং রাসূলের আদেশ নিষেধ পালন, নারী-পুরুষ, স্বামী-স্ত্রী, নির্বিশেষে সকলেরই প্রথম এবং প্রধান কর্তব্য। স্ত্রীর কাছে স্বামীর মূল্য অনেক অনেক বেশী। তবে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের সম্মান ও মূল্যের চেয়ে বেশী নয়। নারীর হেফাযতযোগ্য সম্পদ তার সতীত্ব। নারীর জন্য এর চেয়ে মূল্যবান সম্পদ আর নেই। আজন্ম সাধনা আর সংগ্রাম করে হলেও এ সম্পদ নারীকে রক্ষা করতেই হবে।

বর্তমানে অত্যাধুনিক যুগে, অনেক স্বামী আছেন যারা ঘরে দশ থেকে বিশ বৎসরের কাজের মেয়ে রাখেন এবং স্ত্রীর সম্মুখে বা অগোচরে এদের দ্বারা হাত-পা টেপাতে ও শরীর ম্যাসেজ করাতে ভীষন উৎসাহ বোধ করেন। স্ত্রী বাধা দিতে এলে স্ত্রীর উপর চলে অকথ্য গালিগালাজ ক্ষেত্র বিশেষে মারধর।
“লোক সমাজের দৃষ্টিতে যা ঘৃণিত, তাই পাপ।”এসব স্বামী পাপ-পূর্ণের তফাৎ বোঝেন না। কিংবা বুঝেও না বোঝার ভান করেন। যে বুঝে না তাকে বোঝানো যায়। কিন্তু যে বুঝেও না বোঝার ভান করে তাকে বোঝানো কঠিন।

বনী ইসরাঈলের ৩২ নম্বর আয়াতে আছে-“তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়োনা। নিশ্চই এটা অশ্লীল কাজ এবং অসৎ পন্থা।”

সূরা আনআম এর ১৫১ নম্বর আয়াতে আছে-“লজ্জাহীনতার যত পন্থা আছে তার নিকটেও যেয়ো না। তা প্রকাশ্যেই হউক আর গোপনেই হউক।”

স্বামী-স্ত্রী তথা নারী-পুরুষ সকলকেই ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে সম্মান ও শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার্থে এবং দৈহিক-মানবিক প্রশান্তির লক্ষ্যে সকল প্রকার ব্যভিচার ও লজ্জাহীনতার কাজ থেকে দূরে থাকতে হবে। ব্যভিচার, অশ্লীল কাজ, অসৎ পন্থা আর লজ্জাহীনতার কাজ যত গোপনেই করা হোক না কেন, কেউ না দেখুক স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তো দেখছেনই। তাই আল্লাহকে ভয় করতে হবে। আল্লাহ আল আদলু- ন্যায় বিচারক, আল হালিমু- মহা ধৈর্যশীল।

আল্লাহ এই পৃথিবী নামক পরীক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের সব কিছুই অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে লক্ষ্য করে যাচ্ছেন। দুনিয়াতেও কেউ কেউ অশান্তি নামক সাময়িক শাস্তিতে পতিত হচ্ছেন। আর পরকাল ও আখেরাতে আছে চরম শাস্তি। এখনও সময় আছে তওবা করে নিজেকে সংশোধন করে নিন। আল্লাহ আল গাফফারু- মহা ক্ষমাশীল, ন্যায় বিচারক। তাই ন্যায়-অন্যায় ভালো-মন্দ সবকিছুর ন্যায়সম্মত ও সর্বাপেক্ষা সঠিক বিচার কেয়ামত ও হাশরের মাঠে একদিন হবেই হবে।

ইসলাম অর্থ শান্তি। তাই যে বা যারা যতবেশী ইসলামের নিয়ম-নীতির মাঝে থাকতে পারবেন, তিনি বা তারা তত বেশী সুখ ও শান্তির অধিকারী হবেন।

সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে
যদি স্বামী-স্ত্রী দ’ুজনারই পরকালের ভয় থাকে আপন মনে।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেনÑ ‘স্ত্রী লোকের বেহেশত এবং দোযখ বলতে তার স্বামী।’  (আহমদ নাসাঈ) । ঠিক তাই। স্বামী-স্ত্রীর মিল মহব্বত থাকলে সে গৃহে স্বর্গের সুশীতল বাতাস বইতে থাকে। আর অমিল থাকলে তা নরকের যন্ত্রনার চেয়েও অধিকতর যন্ত্রনাদায়ক মনে হয়।

রসুলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেন-“আল্লাহ তা’আলার নিকট সেই স্বামী-স্ত্রীই মর্যাদার দিক থেকে নিকৃষ্টতর যারা একে অন্যের নিকট গমন করে, অথচ পরে পরস্পরের গোপন রহস্য অন্যের নিকট প্রকাশ করে।   (মুসলিম, আবু দাউদ)

রাসূলে আকরাম (সাঃ) এরশাদ করেন, যে স্ত্রীলোক স্বামীর বিনা অনুমতিতে ঘরের বাইরে পা বাড়ায়, সে যতক্ষন ঘরে প্রত্যাবর্তন না করে, ততক্ষন পর্যন্ত সমস্ত ফেরেস্তারা তার উপর অভিসম্পাত করতে থাকেন।  (তাবারানী)

অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর গোপন কথা, আচরণ এসব বাইরে প্রকাশ করা একেবারেই অনুচিত। যারা এরুপ করে বুঝতে হবে তারা বিকৃত রুচি ও মন-মানষিকতা সম্পন্ন।

ইসলামের নিয়ম অনুযায়ী বিয়ের চুক্তিতে স্বামী পক্ষের শপথ হলো, ‘আমি আমার স্ত্রীর (১) খোরাক (২) পোশাক (৩) বাসস্থানের দায়িত্বভার এবং (৪) স্ত্রীর ইজ্জ্বত, আবরু হেফাজতের দায়িত্বভার গ্রহণ করছি (৫) স্ত্রীর সাথে যাবজ্জীবন সদ্ধ্যবহার করার অঙ্গীকার করছি।

স্বামীর উপর স্ত্রীর কি কি অধিকার রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হলে, তিনি বললেন, “স্ত্রীর অধিকার হলো- যখন স্বামী খাবে, তখন তাকেও খাওয়াবে। স্বামী যখন যে মানের কাপড় পরবে, তখন স্ত্রীকেও সে মানের কাপড় পরাবে। স্ত্রীর মুখে আঘাত করবেনা। অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করবে না। গৃহ ব্যতীত অন্য কোথাও তার সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করবে না।”  (আবু দাউদ)

হযরত আবু মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনÑ “পরকালের ছওয়াবের নিয়তে যখন কোন ব্যক্তি আপন পরিবার-পরিজনের প্রয়োজনে ব্যয় করে, তখন তা তার জন্য সদকা স্বরুপ হয়।” (বুখারী শরীফ)

অর্থাৎ আল্লাহর রাস্তায় সদকা বা দান করে যেভাবে মানুষ ছওয়াবের অধিকারী হয়, স্বামী নেক নিয়তে স্ত্রী ও পরিবার-পরিজনের ভরণ-পোষণ ও প্রয়োজনীয় সকল ব্যয় করেও অনুরুপ ছওয়াবের অধিকারী হতে পারবে।

ইসলামে স্ত্রীর দায়িত্ব- সন্তান লালন-পালন, সুশিক্ষা দান, শশুড়-শাশুড়ী এবং পরিবারের অন্যান্যদের সাধ্যমত সেবা-যতœ করা। অর্থাৎ ঘরের দায়ীত্ব স্ত্রীর আর বাইরের দায়ীত্ব স্বামীর। তাই স্বামীর বর্তমানে স্ত্রীর জন্য ঘরের বাইরে যাবার কোন প্রয়োজন নেই। তার পরেও কোন বিশেষ প্রয়োজনে বাইরে যেতে হলে স্বামীর অনুমতি নিয়েই ঘরের বাইরে যেতে হবে। অন্যথায় পাপ হবে।

হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সাঃ) বলেছেনÑ “যে মহিলা পাঁচ ওয়াক্ত নামায নিয়মিত আদায় করবে, রমযানে রোযা রাখবে, নিজের ইজ্জত আবরুর হেফাজত করবে, এবং স্বামীর অনুগত থাকবে, বেহেশতের যে কোন দরজা দিয়ে প্রবেশ করার অধিকার তার থাকবে।”  (মিশকাত)

হযরত উম্মে সালমাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আর একটি হাদীসে পাই, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনÑ “যে মহিলা স্বামীকে সন্তুষ্ট রেখে মৃত্যু বরণ করে, সে অনায়াসে বেহেশতে প্রবেশ করবে।”  (তিরমিযী)

অর্থাৎ স্ত্রীর জন্য স্বামীর সন্তুষ্টিই বড় সন্তুষ্টি। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর সন্তুষ্টি থাকলে, আল্লাহও সন্তুষ্ট। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর যদি এলার্জি না থাকে এবং স্বামী যদি স্ত্রীকে ইসলাম বিরোধী কোন কাজ করতে না বলেন, তবে স্ত্রীর অবশ্যই উচিৎ স্বামীর অনুগত হয়ে থাকা। এতে সংসার সুখের হবে, স্বামীর মনও পাওয়া যাবে। অতি কাঙ্খিত বেহেশতে যাওয়াও সহজ হবে।

স্বামীকেও স্ত্রীর প্রতি হতে হবে সহনশীল। সূরা নিসার ৪নং আয়াতে বলা হয়েছে, “তোমরা সন্তুষ্টচিত্তে স্ত্রীগণকে তাদের প্রাপ্য মোহর দিয়ে দাও।” দেনমোহরের হকদার হচ্ছেন স্ত্রী। বর্তমানে আমাদের দেশে স্ত্রীকে দেনমোহরতো দেনইনা বরংচ পাত্রপক্ষ কণে পক্ষের কাছে গহনা, নগদ টাকা, আসবাবপত্র আরো বিভিন্ন রকমের যৌতুক দাবী করেন। যৌতুক চাওয়া আইনত নিষিদ্ধ বলে এখন যৌতুকের নামকরণ হয়েছে ‘সম্মানী’। স্ত্রী পক্ষ থেকে স্বামী পক্ষের জন্য সম্মানী কিংবা উপহার।

রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি মোহর ধার্য করে কোন মেয়েকে এই নিয়তে বিয়ে করে যে, উক্ত মোহর দিবে না, সে ব্যভিচারী। আর যে ব্যক্তি কোন ঋণ এই নিয়তে গ্রহন করে যে তা শোধ করবে না, সে চোর।”

উকবা ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্নিত, নবী করীম (সাঃ) বলেছেনÑ “মোহরের মধ্যে সেই পরিমান মোহরই উত্তম, যা আদায় করা সহজ সাধ্য।  (নায়লুল আওতার)

অবলা নারী, অসহায় স্ত্রীকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা ঠিক নয়। মোহর পাত্রের সামর্থ অনুযায়ী নির্ধারন করা উচিৎ। এবং বিয়ের সাথে সাথেই স্ত্রীর মোহরানা শোধ করে দেয়া উচিৎ।
এ সম্পর্কে সূরা নিসার ২৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- “তাদের মোহর তাদেরকে ফরয হিসাবে দাও।”

স্বামী সে বাইরে যতই ভালো হোক না কেন, সে যদি ঘরে তার স্ত্রী ও পরিবার পরিজনের কাছে ভালো না হয়, তবে সে প্রকৃত ভালো হিসাবে গণ্য হবে না।

এ প্রসঙ্গে দুটি হাদীস উল্লেখ করা যায়,
(১) হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সাঃ) বলেছেনÑ “তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি সবচেয়ে উত্তম, যে তার পরিবার-পরিজনের নিকট উত্তম। আমি আমার পরিজনের কাছে তোমাদের সকলের চেয়ে উত্তম।   (তিরমিযী, দারেমী)

(২) হযরত আয়শা (রাঃ) হতে বর্নিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনÑ "পূর্ণ মুমিন সেই ব্যক্তি, যার চরিত্র উত্তম। এবং সে তার পরিবার-পরিজনের (স্ত্রী-পুত্রদের) প্রতি সদয়।"  (তিরমিযী)

স্বামী-স্ত্রী দুজনেই যখন উত্তম চরিত্রের অধিকারী হবেন, তখন এই পৃথিবীর ছোট সংসারটিই সুখের স্বর্গরাজ্য হয়ে যাবে। সুখ পাখির পিছে প্রাণপণ ছুটতে হবেনা। সুখ পাখিটি আপনা আপনিই এসে স্বামী-স্ত্রীর ছোট্ট ঘরে চিরস্থায়ী বাসা বানাবে, তখন আর হতাশা ও দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে গাইতে হবে না-
'সুখ তুমি কি? বড় জানতে ইচ্ছে করে।’

হুযুর (সাঃ) বলেছেন, কুরাইশ মহিলাদের মধ্যে তারাই উত্তম, যারা নিজেদের শিশু সন্তানদের প্রতি অধিকতর স্নেহশীলা এবং স্বামীর সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণকারিণী।  (বুখারী শরীফ)

বর্তমান যুগের কোন কোন স্ত্রীরা স্বামীর সংসারের কাজ করতে অপমানিত বোধ করেন। অথচ দোজাহানের বাদশাহ হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)- এর অতি আদরের কন্যা ফাতেমা (রাঃ) স্বামীর সংসারে যাঁতা ঘুরাতে ঘুরাতে হাতে ফোস্কা পড়ে গিয়েছিল।

স্বামীর আর্থিক সামর্থ থাকলে স্ত্রীকে সাহায্য-সহযোগীতার জন্য গৃহ পরিচারিকা রাখা উচিৎ। অন্যথায় নিজেই ঘরের কাজে স্ত্রীকে সহযোগীতা করা কর্তব্য। এতেও দোষের কিছু নেই। কারণ হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নিজে পরিবারের যাবতীয় কাজে স্ত্রীদের সহযোগীতা করতেন। এমনকি তিনি আয়েশা (রাঃ) কে রুটি বানানোর কাজেও সাহায্য করতেন।

আসওয়াদ ইবনে ইয়াযিদ হতে বর্ণিত, তিনি বলেনÑ “আমি আয়েশা (রাঃ) প্রশ্ন করলাম, হুযুর (সাঃ) বাড়ীতে কি করতেন? তিনি বললেন, পরিবারের যাবতীয় কাজ করতেন। আযান শুনলে বাইরে চলে যেতেন।”

স্ত্রীদেরকে অবশ্যই শরীয়তসম্মত পর্দার ভেতর থাকতে হবে। স্ত্রী যত বেশী বেগানা পুরুষের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করবে এবং গল্প-গুজব করবেÑ ততই সে দিন দিন স্বামীর অবাধ্য হয়ে যাবে, তাই সাংসারিক শান্তি রক্ষার্থে স্ত্রীর জন্য পর্দা রক্ষা করা আবশ্যক।

এ প্রসঙ্গে সূরা নূরের ৩০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেÑ “হে নবী! মুমিন স্ত্রী লোকদের বলে দিন, তারা যেন নিজেদের চোখকে বাঁচিয়ে রাখে। এবং নিজেদের লজ্জাস্থান সমূহের হেফাজত করে ও নিজেদের সাজসজ্জা না দেখায়। কেবল সেই সব স্থান ছাড়া যা আপনা থেকেই প্রকাশিত হয়ে পড়ে। এবং নিজেদের বুকের উপর ওড়নার আঁচল ফেলে রাখে। আর নিজেদের সাজসজ্জা প্রকাশ করবে না।”

ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সাঃ) বলেছেনÑ "মহিলারা হল পর্দায় থাকার বস্তু। সুতরাং তারা যখন (পর্দা উপেক্ষা করে) বাইরে আসে, তখন শয়তান তাদেরকে (অন্য পুরুষের চোখে) সুসজ্জিত করে দেখায়।" (তিরমিযী)

দৃষ্টির অসাধারণ শক্তি আছে বলেই আল্লাহ পাক পুরুষ ও নারীকে দৃষ্টি নিয়ন্ত্রন করার জন্য আদেশ করে বলেছেন যেÑ “মুসলিম নর-নারী যেন স্বীয় চোখের দৃষ্টি নীচের দিকে রাখে।”

নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, “আল্লাহর অভিশাপ ঐ সকল নারীদের উপর যারা কাপড় পড়লেও উলঙ্গ মনে হয়।”
হযরত ওমর (রাঃ) বলেন, “নারীদের এমন আঁটসাঁট কাপড় পড়তে দিওনা যাতে শরীরের গঠন পরিস্ফুটিত হয়ে পড়ে।”

শিক্ষিত অশিক্ষিত, ধনী-গরীব, সুন্দর-কুৎসিৎ সকল স্ত্রীদেরকেই তার স্বামীর পূর্ণ আনুগত্য স্বীকার করে নিতে হয়। মনে প্রাণে স্ত্রীকে উপলব্ধি করে নিতে হবে যেÑ
* স্বামীর গার্হস্থ্য বিষয়াদি স্ত্রীর গার্হস্থ্য বিষয়।
* স্বামীর সন্তান স্ত্রীর সন্তান।
* স্বামীর মান-ইজ্জত স্ত্রীর মান ইজ্জত।
* স্বামীর সন্তান-সন্তুতি লালন-পালন করা স্ত্রীর দায়িত্ব।
* স্বামীর শরীর ও স্বাস্থ্যের প্রতি লক্ষ্য রাখাও স্ত্রীর দায়ীত্ব।
* স্বামী এবং স্ত্রী উভয়েই যদি উভয়ের দায়ীত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন থাকেন, তবে সংসার হবে সুশৃঙ্খল এবং আসবে শান্তি।


রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেনÑ“আমার আদর্শ বৈবাহিক জীবন যাপন করা। যে আমার আদর্শকে তুচ্ছজ্ঞান বা ঘৃনা করবে তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।”
আসুন আমরা স্বামী-স্ত্রী সকলে নবীর আদর্শে উজ্জিবীত হয়ে পথ চলি, নবীর সুরে কথা বলি। লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ হতে বেঁচে থাকি।

‘অভাব এলে ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালায়।’ আমাদের জীবনে যেন এমনটি না ঘটে।
পার্থিব ও বৈষয়িক বিষয়ে সব সময় আমাদের চেয়ে নিম্ন অবস্থা সম্পন্নদের প্রতি দৃষ্টি রাখবো এবং দ্বীনের কাজে যারা আমাদের উর্ধ্বে সর্বদা তাদের অনুসরণ করবো। তাহলে আমরা দুনিয়ায়ও সুখী হবো। পরকালের জন্যও নেক-আমল করার তৈফিক পাবো।

‘কোথায় স্বগর্, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদুর,
মানুষের মাঝেই স্বর্গ-নরক, মানুষেতেই সুরাসুর।’
প্রীতি ও প্রেমের পূণ্য বাঁধনে সবে মিলিব পরস্পরে,
বেহেশত আসিয়া দাঁড়াবে তখন আমাদেরই কুড়ে ঘরে।'



প্রকাশ ঃ দৈনিক ইনকিলাব, (ইসলামী জীবন)
২০, ২২, ২৭ জুলাই, ২০০৮।               
          

No comments:

Post a Comment