Sunday 11 May 2014

টপিপিি : র্পদার আড়ালে গোপন চুক্তি


মাসুম বিল্লাহ,

Journalist,
The Financial Express.
--------------------------


এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার দেশগুলোতে  অধিকতর উদার অর্থনীতির লক্ষ্যে ২০০৫ সালে ব্রুনাই, চিলি, নিউজিল্যান্ড সিঙ্গাপুর ''ট্রান্স-প্যাসিফিক ইকনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট'' বা পি- নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে।
২০১৩ সাল নাগাদ এই অংশীদারিত্ব চুক্তির আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ আরো অনেক দেশ যুক্ত হয়। সেই সঙ্গে চুক্তির নামে কিছুটা পরিবর্তন এনে  করা হয় ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ বা টিপিপি। বাহ্যত এই চুক্তির উদ্দেশ্য হলো একবিংশ শতাব্দির উপযোগী করে একটি উচ্চ মানের বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন। 

 অংশগ্রহণকারী পক্ষগুলো এই চুক্তির আওতায় বেশ কিছু গোপন আলোচনায় অংশ নেয়। এতে বিশ্বব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠে। গত ১৩ নভেম্বর এই চুক্তিরমেধাসম্পদ অধিকার বিষয়ক খসড়াটি প্রকাশ করে উইকিলিকস। এরপর সমালোচনা রীতিমত প্রতিবাদের রূপ নেয়। এই চুক্তি কার্যকর হলে মার্কিন কংগ্রেস, মার্কিন নগর কাউন্টি সরকারের আইনী ক্ষমতা বহুজাতিক সংস্থা বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার জবাবদিহিতার উর্ধ্বে থাকা আন্তর্জাতিক আমলাদের কাছে চলে যাবে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এই চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রাজ্য আদালতগুলোর বিচারিক ক্ষমতায় চলে যাবে টিপিপি বিচারক, আঞ্চলিক ট্রাইব্যুনাল ডব্লিউটিওর কাছে। এই চুক্তির ফলে বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ব্যাপক সুবিধা পেলেও দেশীয় মাঝারি ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলো হুমকির মুখে পড়বে।

টিপিপিকে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের একটি পথপ্রদর্শক চুক্তি হিসেবে দেখা হয়। যা এপেক-চুক্তির আওতা ছাড়িয়ে যাবে। ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র টিপিপি দেশগুলোর সঙ্গে আর্থিক খাতে বাণিজ্য উদারীকরণ নিয়ে আলোচনা শুরু করতে রাজি হয়। পরের বছর নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রকে এই চুক্তির পক্ষ হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া হয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, শুরুতে এই বাণিজ্য চুক্তিতে থাকা স্ট্রাটেজিক ইকনমিক শব্দ দুটি সম্ভবত ইচ্ছে করেই উহ্য রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র মিত্ররা। তাদের মতে, বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ৬০০ বহুজাতিক কোম্পানি যেকোন দেশের পরিবেশ, শ্রমবাজার, আর্থিক অন্যান্য নিয়ম-কানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে ব্যবসা করার জন্য এই চুক্তি সম্পাদনের চেষ্টা করছে। বৈশ্বিক সরবরাহ শেকলকে সবরকম বিধিনিষেধের বাইরে নিয়ে আসা এর লক্ষ্য। এটা একবিংশ শতাব্দিতে রাষ্ট্রের সার্বভৌম অখ-তার ওপর নব্য-উদারবাদীদের একটি বড় আঘাত। এই চুক্তির আলোচনায় ''কৌশলগত অর্থনৈতিক অংশিদারিত্ব'' থেকে নজর অন্যদিকে সরাতে যুক্তরাষ্ট্র এর নাম দিয়েছে প্যাসিফিক পিভোট

টিপিপি-তে অংশ নেয়ার পর ২০০৯ সালের নভেম্বর টোকিওতে দেয়া ভাষণে ওবামা বলেন, বহুজাতিক সংস্থাগুলোর অগ্রগতি এই অঞ্চলের নিরাপত্তা সমৃদ্ধিকে এগিয়ে নিতে পারে। তিনি আরো বলেন, এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নির্মাণের আলোচনায় অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহী।

টিপিপি আলোচনায় অংশ নেয়ার আগে ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর-এর মাঝামাঝি যুক্তরাষ্ট্রের লেহম্যান ব্রাদার্স দেউলিয়া হয়ে পড়ে। এতে দেশটির আর্থিক খাতে ধস শুরু হয় লেহম্যান ব্রাদার্স- যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বহুজাতিক কোম্পানির স্বল্পমেয়াদী বিনিয়োগ ছিল। এসব কোম্পানির প্রধান নির্বাহীরা সেসময়ের অর্থমন্ত্রী হ্যাঙ্ক পালসনকে হুমকি দিয়ে বলেন, আর্থিক পুন:রুদ্ধারের জন্য ক্ষতিপূরণ না দেয়া হলে তাকে পদত্যাগ করে চলে যেতে হবে। সেই সঙ্গে সরকারকে নজিরবিহীন বেকারত্বের মুখোমুখি হতে হবে বলেও তারা সরকারকে সতর্ক করে দেয়। প্রধান নির্বাহীদের জন্য উদ্ধার কর্মসূচীর ব্যবস্থা করা না হলে সেবা খাতের ৯৯% কর্মচারির বেতন বন্ধের উপক্রম হয়। ফলে, ২০০৮ সালের অক্টোবর প্রেসিডেন্ট বুশ ৭০০ বিলিয়ন ডলারের ট্রাবল এসেট রিলিফ প্রোগ্রাম (টিএআরপি) নামে একটি পুনরুদ্ধার কর্মসূচি অনুমোদন করেন। ২০০৯ সালের মার্চের মধ্যে নতুন ওবামা প্রশাসন এই উদ্ধার কর্মসূচিতে .৭৭ ট্রিলিয়ন ডলার বরাদ্দের ঘোষণা দেয়। ওবামা প্রশাসন আর্থিক ধসের পাশাপাশি উত্তরাধিকার সূত্রে টিপিপিও পেয়েছে।

২০১১ সালের মধ্যে ট্রান্স-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজিক ইকনমিক পার্টনারশিপ আলোচনায় ৯টি দেশ অংশ নেয়। সেসময় হাওয়াইয়ে অনুষ্ঠিত এপেক সম্মেলনে ঘোষণা করা হয় যে, কানাডা মেক্সিকো আলোচনায় যোগ দিচ্ছে। আর, জাপানের অংশ গ্রহণের বিষয়টি সময়ের ব্যাপার মাত্র। বর্তমানে টিপিপির সদস্য ১২টি রাষ্ট্র। এদের মোট জিডিপি ২৬ ট্রিলিয়ন ডলার। যা বিশ্বের মোট জিডিপির এক-তৃতীয়াংশের সমান।

২০১১ সালের এপেক সম্মেলনেই ওবামা তার প্যাসিফিক পিভোট নীতি ঘোষণা করেন। এই নীতিতে ইরাক, আফগানিস্তান আটলান্টিক অঞ্চলের ৬০% সামরিক সরঞ্জাম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে স্থানান্তরের কথা বলা হয়েছে। তার একমাস আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী ক্লিনটন প্রথম এই নীতির কথা প্রকাশ করেন। তিনি একে আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরীয় শতাব্দি বলে উল্লেখ করেন। প্যাসিফিক পিভোট-এর দফা পরিকল্পনাও তুলে ধরেন তিনি। এগুলো হলো: . দ্বিপাক্ষিক নিরাপত্তা জোট জোরদার; . উদীয়মান শক্তিগুলোর সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক গভীর করা; . আঞ্চলিক বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ততা; . বাণিজ্য বিনিয়োগ সম্প্রসারণ; . বৃহত্তর সামরিক উপস্থিতি জোরদার; এবং . গণতন্ত্র মানবাধিকার এগিয়ে নেয়া। টিপিপির অগ্রগতি যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা সুসঙ্গত করছে বলে হিলারি উল্লেখ করেন। আর, এতে সরবরাহ শেকলের দক্ষতা বাড়ছে। 

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা টম ডোনিলন বলেন, ‘এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রতি মনযোগ দেয়া কেবল সামরিক উপস্থিতির বিষয় নয়। এটি হলো, যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার সবগুলো উপাদান, সামরিক, রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক বিনিয়োগ, উন্নয়ন মূল্যবোধ একই সঙ্গে ব্যবহারের একটি প্রচেষ্টা।

সাম্প্রতিক সময়ে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রতি মনযোগ নিবদ্ধ করেছে ন্যাটো। সংস্থাটি যুক্তরাষ্ট্রের সামুদ্রিক নিরাপত্তার ওপর জোর দিচ্ছে। ন্যাটোর সাময়িকী আটলান্টিক ভয়েস-এর আগষ্ট সংখ্যায় ন্যাটো এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যে সহযোগিতার গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো তুলে ধরেন বিশ্লেষক মিতহা রিবারনিক। তার মতে, উত্তর কোরিয়া সঙ্কট এমনকি বিতর্কিত দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে চীন-জাপান বিরোধেও ন্যাটো জড়িয়ে পড়তে পারে। পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে এবং যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে পড়লে ওয়াশিংটন ন্যাটো চুক্তির ধারা-, এমনকি ধারা- প্রয়োগ করতে পারে। এতে জোটের ২৭ রাষ্ট্র একযোগে অংশ নেবে। তাই উদ্দেশ্য-বিধেয় যাই হোক না কেন, সবসময়ের জন্য ন্যাটোর একটি পা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে থেকে যাচ্ছে।

টিপিপিতে যোগদানের পর থেকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নতুন অংশীদারিত্ব সৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দ্বীপগুলোকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি সামারিক/কৌশলগত জোট গঠন নিয়ে অনেক দিন ধরে আলোচনা হচ্ছে। যার লক্ষ্য হচ্ছে, প্যাসিফিক প্লান কার্যকর করায় ওই অঞ্চলের অংশীদার দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা। প্যাসিফিক আইল্যান্ড ফোরাম-এর আঞ্চলিক উন্নয়ন বিনিয়োগ প্রস্তাবগুলো এগিয়ে নেয়া। এটা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত যেভাবেই হোক না কেন ওবামা ঘোষিতপ্যাসিফিক পিভোট-এর মতো ঔপনিবেশিক আধিপত্য বিস্তারের নতুন নীল নকসা এই প্যাসিফিক প্লান

এবার আসা যাক কৌশলগত শব্দটির বিশ্লেষণে। এটি এমন এক শব্দ আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলোর প্রেক্ষাপটে যার বহুরকম সুক্ষ্ম অর্থ রয়েছে। যেগুলো প্রায়ই মানুষের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত মাইক্রোনেশিয়া, মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ পালাউ নিয়ে গঠিত হয় অবাধ-সংযুক্ত রাষ্ট্র (ফ্রিলি এসোসিয়েটেড স্টেটস) বা এফএএস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অক্ষশক্তির এলাকা ছিল এই ভূখণ্ডগুলো। এগুলো কোন স্ব-শাসিত অঞ্চল নয়। ১৯৪৭ সালে এফএএসকে জাতিসংঘের স্ট্রাটেজিক ট্রাস্ট ভূখণ্ডের মর্যাদা দেয়া হয়। যেগুলো শাসন কববে যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘের বি-উপনিবেশীকরণ প্রক্রিয়ায় স্বাধীন হওয়া অন্য ৬২টি রাষ্ট্রের মতো এসব ভূখ- কিছু অধিকার ভোগ করলেও তাদের সার্বভৌমত্ব সীমিত। কারণ একে কৌশলগত শব্দ  দ্বারা সীমাবদ্ধ করা হয়েছে।  এসব ভূখণ্ডের নাম উল্লেখের সময় এফএএস শব্দগুচ্ছ উল্লেখ করা না হলেও এগুলোর জনগণ সম্পদ রক্ষায় কৌশলগত ভূমিকা হিসেবে সামরিক ব্যবস্থা নিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।

কৌশলগত শব্দের মতো অর্থনৈতিক সাহযোগিতারও অনেক সুক্ষ্ম অর্থ রয়েছে। মার্শাল প্লান নামে পরিচিত ১৯৪৮ সালের অর্থনৈতিক সহযোগিতা চুক্তি (ইসিএ)টি আসলে একটি উন্নয়ন/সাহায্য বিনিয়োগ কৌশলের চেয়ে অনেক বেশি সামারিক কৌশলগত আন্তর্জাতিক চুক্তি। যুক্তরাষ্ট্রের মুক্ত বাজার নীতি মেনে নেয়া হবে - এই প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরই ইসিএ- আওতায় যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপের উন্নয়ন সাহায্য দেয়া হয়। উন্নয়ন অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য সম্পূর্ণ আলাদা মডেল অনুসরণ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। আর তা ছিল, বাণিজ্যিক সম্পদের জন্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আন্ত:নির্ভরশীলতা। এখানে পূর্ণ কর্মসংস্থানের জন্য রাষ্ট্রগুলোর নিজস্ব অবকাঠামো এবং শ্রম কর্মসূচির কথা বলা হয়। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বক্তব্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর মার্কিন অর্থনৈতিক কৌশল তুলে ধরতে অর্থনৈতিক সহযোগিতা কথাটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। এর লক্ষ্য ছিল সহযোগিতার অংশীদার দেশ ভূখণ্ডগুলোর মুক্ত বাজার উন্নয়ন বাণিজ্যকে একটি কেন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসা। অর্থনৈতিক সহযোগিতা আইন মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের শাখা বিভিন্ন বিভাগ যেমন শ্রম, বাণিজ্য কৃষি, অর্থ, ওয়াশিংটন এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক-এর মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে ইন্টারন্যাশনাল কনফেডারেশন অব ফ্রি-ট্রেড ইউনিয়নস নামে একটি সম্পূর্ণ নতুন আন্তর্জাতিক ইউনিয়ন গড়ে তোলা। এসব বিভাগের মধ্যে সমন্বয় সাধনের উদ্দেশ্য ছিল জাতিসংঘের মাধ্যমে যে পরিবর্তনের জন্য উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে তা নিশ্চিতের পাশাপাশি বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষা। উন্নয়ন সাহায্যের মানে হলো, ইউরোপের অবকাঠামোগত পুনর্গঠন হবে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমের একটি বড় অংশের মাধ্যমে। সেই সঙ্গে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোকে ক্ষুদ্র মাঝারি আকারের ব্যবসার জন্য উন্নয়ন তহবিল সরবরাহ করা হবে। মুদ্রা, বাণিজ্য, জাহাজ চলাচল ব্যাংকিং-এর মতো অনেক ক্ষেত্রে আইনের মৌলিক পরিবর্তন আনার বিনিময়ে সাহায্য দেয়া হয়।

১৯৫১ সাল নাগাদ ইসিএ- নতুন নামকরণ হয় পারস্পরিক নিরাপত্তা আইন। এই আইনে মার্কিন পররাষ্ট্র নীতি বাস্তবায়নে মার্কিন সেনাবাহিনী যাতে ভূমিকা রাখতে পারে তার একটি পরিকাঠামো তৈরি করা হয়। এতে বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর সঙ্গে সামরিক, অর্থনৈতিক কারিগরি সহযোগিতার কথা বলা হয়। যাতে পারস্পরিক নিরাপত্তা, মুক্তবিশ্বের একক সম্মিলিত প্রতিরক্ষা জোরদার, দেশগুলোর স্বাধীনতা নিরাপত্তা এবং যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থে তাদের সম্পদ উন্নয়ন জাতিসংঘের আওতায় সম্মিলিত নিরাপত্তার জন্য ওইসব দেশের কার্যকর অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করা। ১৯৪৮ সালে অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রত্যাখ্যান করলেও অবশেষে ১৯৯৮ সালে, সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্তির বছর পর রাশিয়া এপেক ফোরাম- যোগ দেয়।

যুক্তরাষ্ট্র, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্রুনাই, মেক্সিকো, পেরু, চিলি, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড জাপান-এর মধ্যে একটি কৌশলগত চুক্তি এই ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ বা টিপিপি। এখন সোভিয়েত হুমকি নেই। অথচ টিপিপিতে রাশিয়ার বা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীন-এর অংশগ্রহণ নেই। এতেই বুঝা যায়, টিপিপি আসলে এর মূল চেতনা এফটিএএপি থেকে অনেকটা সরে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র চীনকে তার বিশ্বব্যাপি অর্থনৈতিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে বড় হুমকি বলে মনে করে। দেশটির অর্থনৈতিক উত্থান দমাতে না পারলে টিপিপি কাজ করবে চীন ঠেকাও (চায়না কনটেইনমেন্ট) কৌশল হিসেবে।

দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে। এরপরও চীনের সামরিক আগ্রাসনের চেয়ে এর বিনিয়োগ কৌশলকে আসল হুমকি বলে অনেকে মনে করে যুক্তরাষ্ট্র। চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধিন বিনিয়োগর (এসওআই) কৌশল আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, ক্যারিবীয় অঞ্চল এবং মধ্য/দক্ষিণ আমেরিকান দেশগুলোতে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এসব অঞ্চলের অনেক দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণের জন্য যুক্তরাষ্ট্র মিত্ররা মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছে। মুহূর্তে চীনা বিনিয়োগ বন্ধ করার মতো কোন আইনগত ব্যবস্থা বা কর্তৃত্ব যুক্তরাষ্ট্র বা ইইউর হাতে নেই। ইইউ-যুক্তরাষ্ট্র যে ট্রান্স আটলান্টিক ট্রেড এন্ড ইনভেস্টমেন্ট পার্টনারশিপ (টিটিআইপি) চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছে এর মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিনিয়োগে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সুবিধা পেতে নতুন কৌশল উদ্ভাবন করা হতে পারে।

আঞ্চলিক আন্তর্জাতিক বণিজ্য ক্ষেত্রে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য জোট গড়ে তোলা চীনা অর্থনীতির একটি বড় সাফল্য। যা ইতোমধ্যে ব্রিকস (বিআরআইসিএস) নামে পরিচিতি পেয়েছে। এই জোটের নিজস্ব নতুন মুদ্রাভিত্তিক রিজার্ভ গড়ে তোলারও ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। রিজার্ভ মুদ্রা থাকলে তা জোটের দেশগুলোতে স্থিতিশীলতা রক্ষা বাণিজ্য সুবিধা লাভে সহায়ক হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে স্থিতিশীল মুদ্রা না থাকলে বাজার হয় খুবই ধীর এবং যন্ত্রণাদায়ক।

আমাদের জাতীয় অর্থনীতির শক্তিমত্তা নিরূপনের সাধারণ অর্থনৈতিক সূচক হলো জিডিপি। ১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র এই হিসাবরক্ষণ প্রক্রিয়ার প্রবর্তন ঘটায়। ১৯৯৩ ২০০৮ সালে জাতিসংঘের মাধ্যমে এর পরিবর্তন ঘটানো হয়। ব্রিকস কোন রিজার্ভ মুদ্রা সৃষ্টি করতে পারলে তা উন্নয়নশীল বাণিজ্য অংশীদার দেশগুলোর মুদ্রামান স্থিতিশীল করবে। আইএমএফ-এর ভাষায় এই রিজার্ভ মুদ্রাকে বলা হচ্ছে স্পেশাল ড্রইং রাইট বা এসডিআর। যুক্তরাষ্ট্র ইইউ অর্থনৈতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে ব্রিকস-এর উত্থান কোন কাকতালীয় ঘটনা নয়। এটা অর্থনৈতিক সহযোগিতা চুক্তিগুলোর আরেক পরিণতি।

উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলোর জন্য ব্রিকস-এর উদ্যোগকে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক অন্যান্য বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকল্প হিসেবে চিন্তা করা হচ্ছে। উন্নয়নের নামে দেয়া ঋণ ফেরত পেতে এসব প্রতিষ্ঠান গ্রহীতা দেশের কাঠামোগত পরিবর্তন, যেমন সম্পদ দখল শোষণমূলক শিল্প প্রতিষ্ঠার দাবি করে। কোন উন্নয়ন অবকাঠামো নির্মাণের পর তা থেকে সুফল পেতে যে সময় লাগে তার সঙ্গে বিনিয়োগকারী সংস্থাগুলোর বেধে দেয়া সময় সীমা বা লাভের পরিমাণ কখনোই মানানসই হয় না। কেবল চীনের রাষ্ট্রায়ত্ব বিনিয়োগ ব্যাংকগুলোর মতো দাতারা পারে সরকার বা জনগণের সঙ্গে প্রতারণামূলক হবে না এমনভাবে ঋণ পরিশোধ ব্যবস্থাকে পুনর্গঠিত করতে। গ্রিস-এর বেলায় এমনটা ঘটেছিল। সম্ভবত যুদ্ধোত্তরকালে নিরাপত্তা উন্নয়ন সাহায্য পাওয়া প্রথম দেশ ছিল গ্রিস। গ্রিস তুরস্ককে সহায়তার জন্য ১৯৪৭ সালে যে আইন করা হয় তাই ১৯৪৮ সালের ইকনমিক কোঅপারেশন আইনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

বিশ্বব্যাপী করকাঠামো সংস্কারের মাধ্যমে উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য প্রদানের লক্ষ্যে ২০১২ সালের জুলাইয়ে বিশ্বব্যাংক ৪০০ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ কর্মসূচি শুরু করে। অর্থ সংগ্রহের প্রাথমিক উৎস হিসেবে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কথা ভাবা হয়। জাতিসংঘ ঘোষিত ২০১৫ সালের মধ্যে সহস্ত্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে যে ব্যাপক প্রশাসনিক সংস্কার আন্তর্জাতিক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করে বৈশ্বিক কর ব্যবস্থাকে একটি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা এর লক্ষ্য। ওইসব কর্মসূচিতে অর্থনৈতিক পরিবেশগত সংস্কার, দারিদ্রবিমোচন অন্যান্য উন্নয়ন প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে। এসব বৈশ্বিক প্রশাসনিক সংস্কার সঙ্গতিপূর্ণ করার নামে টিপিটি/টিটিআইপি- মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র তার অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রভাব বিশ্ববাজার সংস্কারে কাজে লাগাবে না তা বলা যাবে না। আরো স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, বিশ্বব্যাপী যে সংস্কার চলছে তা আসলে চীন বা ব্রিকস-কে সামাল দেয়ার জন্য। বিশ্বে যে কোন প্রশাসনিক সংস্কার যেন শিল্পের চাহিদা পূরণের দিকে লক্ষ্য রেখে করা হয় সে জন্য বহুজাতিক কোম্পানি শোষণমূলক শিল্পগুলো বিভিন্ন সরকারের কাছে লবিং করছে। উদাহরণ হিসেবে গত সেপ্টেম্বর জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের কথা বলা যায়। শিল্প অন্যান্য খনিজ খাতের বাণিজ্য কর সংশ্লিষ্ট এক্সট্রাকটিভ ইন্ডাস্ট্রিজ ট্রান্সপারেন্সি ইনিশিয়েটিভ বা ইআইটিআই-এর প্রতি দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করা হয় সম্মেলনে।

অনেকে উত্তর কোরিয়ার মতো একই পদ্ধতিতে চীনকে সামাল দেয়ার পক্ষে কথা বলেন। একে কনটেইনমেন্ট কৌশল-এর চেয়ে কনটেইনারমেন্ট কৌশল বলা যায়। যতদিন বাণিজ্য অংশীদারদের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক গতিশীল থাকবে, ততদিন দেশটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে না। সমুদ্রপথে চীনের পণ্য, সম্পদ তৈরী জিনিস পরিবহন বাধাপ্রাপ্ত হয় এমন অনেক কৌশল অবলম্বন করা হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র যতদিন ট্রান্সপ্যাসিফিক পার্টনারশিপ অব্যাহত রাখবে ততদিন জাহাজ চলাচলের পথ পাহারা এগুলো সামরিকীকরণের দিকে এগিয়ে যাবে।

অনেক খনিজ-সমৃদ্ধ উন্নয়নশীল দেশের কাঙ্খিত বাণিজ্য অংশীদারে পরিণত হয়েছে ব্রিকস অর্থনীতি। যুক্তরাষ্ট্র ইউ- বিনিয়োগ যখন সঙ্কুচিত হচ্ছে তখন তারা  চীনের মতো ম্যানুফ্যাকচারিং পাওয়ারহাউজকে কিভাবে মোকাবেলা করবে তাও একটি বড় প্রশ্ন। ব্রিকস অর্থনীতির উত্থান হলে উন্নয়নশীল দেশগুলো এরপ্রতি আরো ঝুকবে বলে আশা করা যায়।

পুরণো ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর প্রশাসনিক কৌশল অনুসরণ করে যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন মেনেই জাহাজ চলাচল পথগুলো সামরিকীকরণ করছে। কোনদেশের সাগরসীমায় নিরাপদ চলাচল সেই দেশের একটি স্বীকৃত অধিকার। কিন্তু, মাছ শিকার, জীব বৈচিত্র, প্রথা, অভিবাসন, পরিবেশ সুরক্ষা, সামুদ্রিক নিরাপত্তা ইত্যাদি ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের এমন অনেক আইন নতুন চুক্তিগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে যেখানে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় হস্তক্ষেপ করতে পারে। বিভিন্ন আঞ্চলিক জাতীয় সংস্থা এগুলো প্রয়োগ করছে।

আন্তর্জাতিক আইনের মধ্যে থেকেই বিভিন্ন দেশের সমুদ্রসীমায় জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখে যুক্তরাষ্ট্র। এজন্য তারা কথিত নিরাপদ ট্রানজিট প্যাসেজ নীতি প্রয়োগ করতে পারে। এর মাধ্যমে যেকোন মহাসড়কে পুলিশী ব্যারিকেড বসিয়ে যানবাহনে তল্লাসির মতো জাহাজে জাহাজে নজরদারি করতে পারবে দেশটি। গত জুলাইয়ে পানামা খালে এমন একটি ঘটনা ঘটে। কিউবা থেকে চিনি নিয়ে একটি জাহাজ উত্তর কোরিয়া যাচ্ছিল। জাহাজটিতে মাদক আছে এমন অযুহাতে যুক্তরাষ্ট্র এটি থামায় তল্লাশি করে। এতে কিছু অস্ত্রের সন্ধান পেয়ে তা আটক করা হয়। কিউবা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-এর এক বিবৃতিতে বলা হয়, জাহাজটিতে করে তাদের ২৪০ টন পুরণো আত্মরক্ষামূলক অস্ত্র মেরামতের জন্য উত্তর কোরিয়া পাঠানো হচ্ছিল। এসব অস্ত্র প্রায় ৫০ বছরের পুরণো। মজার ব্যাপার হলো, এমন এক সময় এই ঘটনা ঘটে, যার কিছুদিনের মধ্যে নিকারাগুয়া তার ভূখ- সমুদ্রসীমার মধ্য দিয়ে একটি খাল খননের জন্য চীনের একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সঙ্গে চুক্তি করে। ক্যারিবীয় সাগরকে প্রশান্ত মহাসাগরের সঙ্গে যুক্ত করবে এই খাল। এতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আওতার বাইরে থেকেই আটলান্টিক প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বাণিজ্য অংশীদাররা পণ্য পরিবহন করতে পারবে। এই বিনিয়োগের পেছনে বেইজিং-এর আগ্রহ থাকার কথা জানা যায়।

আঞ্চলিক মুক্তবাণিজ্য চুক্তি অন্যান্য দ্বিপাক্ষিক চুক্তিগুলোর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র তার কৌশলগত অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তার অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারী কৌশল প্রয়োগ করতে পারে। এগুলো দিয়েই সামুদ্রিক নিরপত্তার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের জনগণের সমর্থন আদায় করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। মানচিত্রে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, রাশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে চীনের কাঁচামাল আমদানির পথগুলো চিহ্নিত করে সেখানে বিভিন্ন বাণিজ্য চুক্তিভুক্ত দেশগুলোকে স্থাপন করা হলে দেখা যাবে চীনা রুটগুলোর বেশিরভাগ পড়েছে চুক্তিভুক্ত দেশগুলোর আওতায়। এসব দেশের সমুদ্রপথ সামরিকীকরণ করা হলে চীনের সেগুলো এড়ানোর কোন সুযোগ থাকবে না। তাই ইতোপূর্বে বিভিন্ন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকেই এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল অস্থিতিশীল।

এসব সমুদ্রপথের একটি মালাক্কা প্রণালী। এটা মালয়েশিয়া সিঙ্গাপুরের সামুদ্রিক সীমানাভুক্ত এবং চীনের মধ্যপ্রাচ্য আফ্রিকায় যাতায়াতের প্রধান পথ। যুক্তরাষ্ট্রের কমান্ডার, লজিস্টিক গ্রুপ ওয়েস্টার্ন প্যাসিফিক (কমলগ ওয়েস্টপ্যাক)-এর আওতায় এসব পথে ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র তার  উপস্থিতি জোরদার করেছে। ১৯৯২ সালে ফিলিপাইনের সুবিক উপসাগর থেকে এই কমান্ড সরিয়ে সিঙ্গাপুর বন্দর কর্তৃপক্ষের অধীনে নিয়ে আসা হয়। এছাড়া স্পার্টলি দ্বীপপুঞ্জের কথা বলা যায়। এর ৪৫টির মতো দ্বীপ সামরিক শক্তিবলে দখল করে আছে চীন, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ব্রুনাই। চীন ছাড়া স্পার্টলি দ্বীপপুঞ্জের দাবিদার বাকি দেশগুলো টিফা- (টিআইএফএ) সদস্য। ফিলিপাইন টিফা ছাড়াও আসিয়ানের সদস্য। সংস্থাটি দীর্ঘদিন ধরে এই ঐতিহাসিক বিরোধ নিস্পত্তির চেষ্টা চালিয়ে আসছে।

আসিয়ান আঞ্চলিক ফোরাম হলেও যুক্তরাষ্ট্র এর পর্যবেক্ষক। চীন আসিয়ানের মধ্যে বর্তমানে যে আলোচনা চলছে তাকে চীনের নেতৃত্বে আরেকটি টিপিপি (ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ)-বিরোধী বাণিজ্যিক জোট - রিজিওনাল কমপ্রিহেন্সিভ ইকনমিক পার্টনারশীপ (আরসিইপি) হিসেবে দেখা হচ্ছে। টিপিপি অথবা আরসিইপি যার আলোচনা আগে শেষ হবে তা অঞ্চলের বাণিজ্যিক বিধিমালা ঠিক করবে। টিপিপি আগে সমাপ্তিতে পৌছালে তাতে যুক্তরাষ্ট্রের চাহিদামতো আইন-কানুন প্রাধান্য পাবে। তখন চীনের তাতে যোগদানের বিষয়টি ঐচ্ছিক হয়ে পড়বে। আরসিইপি আলোচনা আগে শেষ হলে যুক্তরাষ্ট্রের আসিয়ানে যোগদানের প্রশ্নটিও একই রকম দাঁড়াবে। তবে এটা ঠিক টিপিপি বা আরসিইপি একবার শেষ হলে চীন বা যুক্তরাষ্ট্র কেউই এর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকবে না। তাই মুহূর্তে আসল লড়াই হচ্ছে বিনিয়োগ বাণিজ্য আইন নিয়ে।

কোরিয়া প্রণালীর একেবারে প্রান্তে অবস্থিত জেজু দ্বীপ এখন দক্ষিণ কোরিয়ার দখলে। দক্ষিণ চীন সাগর থেকে শুরু করে জাপান সাগর পর্যন্ত গোটা এলাকা এর আওতায়। এটি ইউনেস্কোর একটিওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। ১৯৪৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় গণতান্ত্রিক গণঅভ্যুত্থানের সময় সেনাবাহিনীর হাতে ৮০ হাজারের বেশি বেসামরিক মানুষ নিহত হয়। এরপর থেকে জেজু দ্বীপটি শান্তির দ্বীপ হিসেবে সেই গণঅভ্যুত্থানের প্রতীক হয়ে আছে। এটি একটি বড় পর্যটন কেন্দ্র। ২০১১ সালে দক্ষিণ কোরিয়া দ্বীপটি সামরিকীকরণ করলে ব্যাপক বিতর্ক দেখা দেয়। ২০০৭ সালে কোরিয়া এফটিএ স্বাক্ষর করে। ২০১১ সালে ঠিক একই রকম আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষর করে সিউল। তাই এরপরই জেজু সামরিকীকরণ কোন কাকতালীয় ঘটনা নয়।

২০১০ সালের ২৬ মার্চ ওই অঞ্চলে দক্ষিণ কোরিয়ার একটি যুদ্ধ জাহাজে বিস্ফোরণে ৪৬ জন সেনা প্রাণ হারা। আন্তর্জাতিক তদন্তে দেখা যায় উত্তর কোরিয়ার টর্পেডোর ঘায়ে জাহাজটিতে বিস্ফোরণ এবং পরে তা ডুবে গিয়েছিল। ঠিক সেসময় যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে একটি বড় আকারের নৌযুদ্ধ মহড়া চলছিল। উত্তর কোরিয়া দাবি করে যুদ্ধ মহড়া চালানোর সময় দক্ষিণ কোরিয়ার জাহাজটি উত্তর কোরিয়ার সীমানায় প্রবেশ করে। সেই জাহাজডুবি নিয়ে বিতর্ক এখনো শেষ হয়নি। ঘটনা যাই হোক, এই ঘটনার পর ওই অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতি জোরদারের প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ায় জনসমর্থন বেড়ে যায়।

জেজুর ঘটনা চায়না কনটেইনারমেন্ট তত্ত্বকেও সমর্থন করে। সম্প্রতি চীন অভিন্ন নদী তুমেন-এর উত্তর কোরীয় অংশে স্থাপিত একটি নতুন বন্দর দিয়ে মালামাল পরিবহনের কাজ শুরু করেছে। এই নদী রাশিয়া, চীন উত্তর কোরিয়ার মধ্য দিয়ে গেছে। আগে কাজে রাশিয়ার ভ্লাদিভস্টক বন্দর ব্যবহার করতো বেইজিং। নতুন বন্দরে জাহাজ প্রবেশ-এর অনুমতি দানের ব্যাপারে চীন রাশিয়া সম্প্রতি একটি চুক্তিও করেছে। এই বন্দর ভ্লাদিভস্টকের মতো নয়। এটা অত্যন্ত গভীর এবং সারা বছর কার্যক্রম চালাতে সক্ষম। বরফের কারণে এটি কখনো বন্ধ হওয়ার আশংকা নেই।

এবার আসা যাক সেনকাকু দ্বীপ নিয়ে বিরোধ প্রসঙ্গে। ২০১২- সেপ্টেম্বরে বিরোধপূর্ণ সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জের ৫টি দ্বীপের ৩টি জাপান সরকার কিনে নেয়। ব্যাপারে মালিক পরিবাগুলোর সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে টোকিও। জাপানের ওকিনাওয়া তাইওয়ানের মধ্যে দ্বীপগুলো অবস্থিত। পূর্ব চীন সাগরে চীনের পণ্য রফতানির যে শিপিং লাইন রয়েছে তার কাছাকাছি এই দ্বীপপপুঞ্জের অবস্থান। দ্বীপপুঞ্জ কিনে নেয়ার প্রতিবাদ করে চীন। এর জবাবে জাপানের প্রধানমন্ত্রী নোদা ইংগিত দেন, সেনকাকুর ব্যাপারে বেইজিং সামরিক হস্তক্ষেপ করলে জাপানও তার সেনাবাহিনী ব্যবহার করবে।

জাপান টাইমস-পত্রিকার সাম্প্রতিক এক নিবন্ধে বলা হয়, দ্বীপগুলো কেনার আগে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের সঙ্গে টোকিও কথা বলে। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর থেকে পথে যেতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়।

দ্বীপকেনা চুক্তি স্বাক্ষরের পর জাপান চীনের জাতীয়তাবাদিরা বিক্ষোভ শুরু করে। জাপানের বর্তমান সেনাবাহিনীর ভূমিকা বৃদ্ধি নিয়েও আলোচনা শুরু হয়। জাপানের সংবিধানের ৯নং ধারা সংশোধনের দাবি ওঠে। এই ধারায় দেশটির সামরিক শক্তি অর্জনকে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে।

২০১২ সালের জুলাইয়েএশিয়া সিকিউরিটি ওয়াচ সাময়িকীতে জাপানের আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিবেশ এবং সংঘাতের আশংকা শীর্ষক একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, কৌশলগত বাণিজ্যচুক্তিতে জাপান অংশ নিতে পারে। প্রধানমন্ত্রী নোদা টিপিপিতে অংশ্রগহণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নিলেও তিনি টিপিপির পতাকা উড়িয়ে যাবেন। ক্ষমতাসীন এলডিপি প্রতিরক্ষা নীতির ব্যাপারে জাপানের অবস্থান পরিবর্তন চায়। তারা এখন ধারা -এর সাংবিধানিক ব্যাখ্যার ব্যাপারে দ্বৈত কৌশল অনুসরণ করছে। নোদা একে সম্মিলিত আত্মরক্ষা হিসেবে তুলে ধরেছেন। পার্লামেন্টে বিষয়ে আলোচনা এগিয়ে নিতে চান তিনি। বিশেষ করে, এর মাধ্যমে গভীর সাগরে মার্কিন জাহাজ বহরের সুরক্ষা ব্যালিস্টিক ক্ষেপনাস্ত্রের হামলা থেকে মার্কিন জাহাজ রক্ষার জন্য জাপান তার ব্যালিস্টিক ক্ষেপনাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (বিএমডি সিস্টেম) ব্যবহারের সুযোগ চায়। সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ জাতীয়করণের প্রস্তাব পার্লামেন্টে তুলেছেন নোদা।

টিপিপি আলোচনায় যোগ দেয়ার পর থেকে জাপান টিপিপির একটি ঢাল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে। টিপিপিতে জাপানের যোগদানের বিরোধিতা করছে সেখানকার প্রভাবশালী কৃষিখাতের লবি। তারা বুঝেছেন যে, টিপিপিতে যোগদানের মানে জাপানী কৃষিখাতের মেরুদ- হিসেবে অভিহিত ধান উৎপাদন ক্ষুদ্র পারিবারিক কৃষিখামারগুলো যে সরকারি সুরক্ষা পাচ্ছে তা আর থাকবে না। অন্যদিকে, ব্যবসা-বাণিজ্য, নির্মাণ অটোমোবাইল খাতগুলোর ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে টিপিপি। জাপানী পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে রক্ষণশীল এলডিপির বিজয়ের মধ্যে এই সমর্থন স্পষ্ট।

টিপিপি চুক্তির আলোচনায় রাখঢাক সত্ত্বেও জাপানে নিয়ে আলোচনা শুরু হলে, চুক্তির প্রতিটি ত্রুটি বেশ স্পষ্টভাবে ধরা পড়তে শুরু করে। তাই যারা টিপিপি আলোচনা শুরু হওয়ার পর থেকে যারা এর প্রতি লক্ষ্য রেখেছেন তাদের সামনে একটি প্রশ্ন জাপান এতে যোগদান করবে কিনা।

জাপানি অর্থনীতির আকার প্রভাবের কারণে কেউ কেউ মনে করেন জাপানের যোগদান আলোচনায় স্থবিরতার অবসান ঘটাবে। অন্যরা মনে করেন, এতে দ্রুত আলোচনার সমাপ্তি ঘটবে। যাই হোক না কেন জাপানের যোগদানের আগে নতুন ছাড় দাবি পূরণ করতে হবে এবং এতে যুক্তরাষ্ট-জাপান প্রতিরক্ষা সহযোগিতাও অন্তর্ভুক্ত হবে। গত অক্টোবর টোকিওতে জাপান-মার্কিন উচ্চ পর্যায়ের নিরাপত্তা কমিটির বৈঠকে আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট। কমিটিতে প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি বিনিময়, স্থাপনা নির্মাণ, জাপানের প্রতিরক্ষা বাহিনী শক্তিশালীকরণ, বাণিজ্য, সামুদ্রিক নিরাপত্তা, দুর্যোগ মোকাবেলা, অস্ট্রেলিয়া দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতার ব্যাপারে একটি নতুন পরিকল্পনা এবং জাপানে মার্কিন বাহিনীর নতুন বিন্যাস নিয়ে আলোচনা হয়।

গতবছর মার্চে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে আনুষ্ঠানিকভাবে টিপিপি আলোচনায় যোগদানের কথা ঘোষণা করেন। এর দুমাস পরেই টিপিপির বিকল্প হিসেবে চীনের উদ্যোগে ব্রুনাইয়ে আরসিইপির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত নিউজিল্যান্ড যোগ দেয়। গতবছর জুনে হংকংয়ের ধনকুবের ওয়াং জিং দুই মহাসাগর সংযোগকারী একটি খাল খননের ব্যাপারে নিকারাগুয়ার প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল ওরতেগার সঙ্গে ৪০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এর পরপরই ২৩ জুলাই জাপান দ্বাদশ সদস্য আনুষ্ঠানিকভাবে টিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত হয়। থেকে অনুমান করতে কষ্ট হয় না যে, আগামী দিনগুলোতে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের অনেকখানি নিয়ন্ত্রিত হবে জাপানের টিপিপিতে যোগদানের ফলাফলের ওপর। 

এই হলো টিপিপি। যুক্তরাষ্ট্র এভাবেই প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল জুড়ে একটি দীর্ঘমেয়াদি উত্তেজনা জিইয়ে রাখার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। তখন প্যাসিফিক পিভোটকে সামরিকীকরণ না করে পুরোপুরি অর্থনৈতিক সহযোগিতার মধ্যে ধরে রাখা সম্ভব হবে না। আসল কথা হলো, শেষ পর্যন্ত টিপিপিকে সামরিক উপাদান থেকে মুক্ত রাখা যাবে না। যার মানে হলো, সবাই যেখানে সামরিকায়নের অবসান চায়, সেখানে এই আন্ত:প্রশান্ত মহাসাগরীয় অংশীদারিত্ব মুক্তবাণিজ্যেরই অবসান ঘটাবে

(গ্লোবাল রিসার্স-এর ১০ নভেম্বর ২০১৩ সংখ্যায় প্রকাশিত আরনি সাইকির নিবন্ধ অনুসারে)


1 comment:

  1. Harrah's Casino Tunica, MS 39530 - MapyRO
    Harrah's Casino Tunica, 전주 출장마사지 MS 39530 is 공주 출장샵 an entertainment destination in Mississippi's 익산 출장안마 Upper Peninsula. This casino is a racino 성남 출장마사지 located 화성 출장마사지 in

    ReplyDelete